অনলাইন ডেস্ক: বৈধভাবে বিদেশে কাজ করতে যাওয়ার জন্য জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোতে (বিএমইটি) নিবন্ধিত হতে হয়। এই নিবন্ধন জেলা অফিস কিংবা অনলাইনে ‘আমি প্রবাসী’ অ্যাপের মাধ্যমে করা যায়। নিবন্ধিত হওয়ার পর কর্মীর কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করে ক্লিয়ারেন্স হিসেবে তাকে ‘স্মার্ট কার্ড’ দেওয়া হয়। এই কার্ড সংগ্রহ করে বিদেশে যেতে হয় কর্মীদের। সম্প্রতি বিদেশগামীদের সরলতাকে কাজে লাগিয়ে প্রতারক চক্র একের পর এক ‘বিএমইটি স্মার্ট কার্ড’ জালিয়াতি করে যাচ্ছে। এ কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন বাংলাদেশি কর্মীরা। জয়পুরহাটের কালাই উপজেলার জিন্দারপুর গ্রাম। ওই গ্রামের মো. আল আমিন নামের এক যুবক সংসারে আর্থিক সচ্ছলতা ফেরাতে হাজির হন ওই গ্রামের দালাল সুলতান মাহমুদ মাবুদের কাছে। এই সুলতান মাহমুদ মাবুদ গত কয়েক বছরে গ্রামের যুবকদের বিদেশ পাঠানোর কথা বলে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। সম্প্রতি মাবুদ তাজিকিস্তান পাঠানোর কথা বলে কালাই উপজেলার ছয় যুবকের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন। প্রতারণার শিকার যুবকরা হলেন একই উপজেলার খায়রুল ইসলাম, আবদুল ওয়াদুদ, আলামিন তালুকদার, মেহেদী হাসান, আল আমিন ও আবু তাহের। এই ছয় যুবক বিএমইটি স্মার্ট নকল হওয়ার কারণে বিদেশে যেতে পারেননি। তাদের মতো দোলা, ফারজানা, আলফাজ, হাফিজ ও রুহুল আমিন একই প্রতারণার শিকার হয়েছেন। সবকিছু ঠিকঠাক জেনে বিমানবন্দরে গিয়ে তারা জানতে পারেন তাদের কাছে থাকা বিএমইটি ‘স্মার্ট কার্ড’ নকল। তাদের বিমানবন্দর থেকেই গ্রামে ফিরতে হয়েছে।
এ ঘটনায় দালাল সুলতান মাহমুদ মাবুদের সঙ্গে জড়িত ঢাকার ভাটারা এলাকার মো. আবু আকতার। থাকেন থানার নতুন বাজার এলাকার ওয়াজুদ্দিন রোডের একটি বাড়িতে। সেই বাড়ির নিচতলায় তার একটি অফিসও আছে। সেখানে বিমানের টিকিট, হোটেল বুকিং, ভিসা প্রসেসিং, প্যাকেজ ট্যুর, ইমপোর্ট অ্যান্ড এক্সপোর্টসহ ডিজিটাল মার্কেটিং কাজ করেন বলে ভিজিটিং কার্ডে লিখেছেন। মূলত তার ওই অফিসেই তিনি অর্থের বিনিময়ে নকল বিএমইটি স্মার্ট কার্ড তৈরি করেন। গত ২১ মার্চ রাতে মাত্র ৪০ মিনিটে ৬টি বিএমইটি স্মার্ট বানিয়ে জয়পুরহাটের কালাই উপজেলার ছয় যুবকের হাতে তুলে দেন। স্মার্ট কার্ড নকলের পাশাপাশি তিনি ভিসাও জালিয়াতি করেন বলে জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা।
ভুক্তভোগী মো. আল আমিন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ২০২২ সালে জানুয়ারিতে দালাল সুলতান আমাকে মালয়েশিয়া পাঠানোর কথা বলে ৫ লাখ টাকা নেন। এভাবে আরও পাঁচজনের কাছে একই টাকা নেন। কিন্তু ওই বছর তিনি আমাদের মালয়েশিয়া পাঠাতে পারেননি। তখন আমরা তার কাছে দেওয়া টাকা ফেরত চাই। কিন্তু তিনি টাকা না দিয়ে আমাদের তাজিকিস্তান পাঠাবেন বলে আশ্বাস দেন। তার কথা ধরে আমরা তাজিকিস্তান যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিই। গত ২০ মার্চ আমরা ওই দালালের সঙ্গে ঢাকায় রওনা হই। ঢাকা যাওয়ার পর দালাল আমাদের ভাটারার আরেক দালাল আবু আকতারের বাড়িতে নিয়ে যান। সেখানে আমরা এক দিন থাকি। ওই এক দিনের ভেতরে আমাদের দুবাই ও তাজিকিস্তানের ভিসা দেওয়া হয়। এমনকি ছয়জনের বিএমইটি কার্ড ও বিমানের টিকিটও দেন। তারপর দালালকে সঙ্গে নিয়ে আমরা গত ২২ মার্চ ভোর ৪টা ৩০ মিনিটে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যাই। বিমানবন্দরের দ্বিতীয় টার্মিনাল দিয়ে আমরা ভেতরে প্রবেশ করি।
তারপর দালাল আমাদের একটি মোবাইল নম্বর দেন। নম্বরটি এক পুলিশ সদস্যের বলে দাবি দালাল চক্রের। ওই নম্বরে ফোন করার পর তিনি আমাদের সোনালী ব্যাংকের নিচে বসতে বলেন। তিনি ফোনে জানান, তার কথার বাইরে গিয়ে কিছু করা যাবে না। তিনি যখন বোর্ডিং পাসের জন্য যেতে বলবেন তখনই যেতে হবে। নয়তো ধরা খেতে হবে। কেউ জিজ্ঞেস করলে বলতে হবে, আমাদের ফ্লাইট দেরি আছে, তাই বসে আছি। সেখানে ২০ মিনিট বসে থাকার পর পুলিশ সদস্য আমাদের দুজন করে বোর্ডিং পাসের জন্য যেতে বলেন। এ সময় আমাদের কাছে থাকা দুবাই ভিসা লুকিয়ে রাখতে বলেন। আর তাজিকিস্তান ভিসা হাতে রাখতে বলেন। তার কথা ধরে আমরা বোর্ডিং পাসের জন্য যাই। সেখানে দায়িত্বরত কর্মকর্তারা তাজিকিস্তান যাওয়ার কথা শুনেই আমাদের একপাশে দাঁড়াতে বলেন।
পরে তারা আমাদের ভিসা, বিএমইটি কার্ড ও কাজের কাগজপত্র দেখে জানান, এগুলো সব নকল। আমরা যাদের মাধ্যমে এসেছি তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন। আরও বলেন, আমাদের জেল ও দালাল চক্রের ফাঁসি হওয়া উচিত। অনেক অনুরোধ করার পর সংশ্লিষ্টরা আমাদের বিমানবন্দর থেকে বের হওয়ার সুযোগ দেন। বিমানবন্দর থেকে বের হয়ে জয়পুরহাটের দালালকে নিয়ে আমরা ভাটারার দালাল আবু আকতারের বাড়িতে যাই। সেখানে যাওয়ার পর তিনি বলেন, আমি আগে থেকেই জানতাম আপনারা ধরা পড়বেন। কারণ ভিসা ও বিএমইটি কার্ড সব নকল ছিল। সুলতান মাহমুদের কথায় আমি এসব করেছি। আপনাদের কাজ শেষ করতে আরও ১৫ দিন সময় লাগত। এতে আমার কিছু করার নেই।
এ বিষয়ে মো. আবু আকতারের সঙ্গে কথা হয়েছে এই প্রতিবেদকের। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘তারা আমার কাছে ছিল এটা ঠিক। তারা দালাল ও আমার কারণে বিদেশ যেতে পারেনি এটাও ঠিক। কিন্তু পুনরায় তাদের বিদেশ পাঠানোর জন্য যা করা প্রয়োজন আমরা করব।’ ওই ছয় যুবকের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন কি না এমন প্রশ্ন করলে তিনি উত্তেজিত হয়ে যান। এ সময় তিনি বলেন, ‘প্রতারণা করেছি কি না সেটা আমি জানি, আপনি স্বীকারোক্তি নেওয়ার কে? স্বীকারোক্তি নেওয়ার জন্য ফোন দিয়েছেন। এ ছাড়া তিনি সাংবাদিকদের নিয়ে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করেন। আপনাদের মতো সাংবাদিকদের আমি পকেটে নিয়ে ঘুরি।’
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের ২৭ ডিসেম্বর থেকে চলতি বছরের ৪ জানুয়ারির মধ্যে ‘আমি প্রবাসী’ অ্যাপের মাধ্যমে ২০টি স্মার্ট কার্ড জালিয়াতির ঘটনা ঘটে। এ ঘটনা জানাজানির পর ১০ জানুয়ারি ছয় সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে বিএমইটি। গত ৭ ফেব্রুয়ারি সেই প্রতিবেদন জমা দেয় কমিটি। কমিটিতে প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় ‘আমি প্রবাসী’ ও সরকারের তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিভাগের সংস্থা বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের (বিসিসি) প্রতিনিধি রাখা হয়। প্রতিবেদনে তারা চূড়ান্তভাবে কাউকে দায়ী না করলেও ‘আমি প্রবাসী’ অ্যাপের সিস্টেমে কিছুটা দুর্বলতার কথা তুলে ধরেছেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘আমি প্রবাসীর’ সিস্টেমে লগইন করে রেখে দিলে লম্বা সময়েও স্বয়ংক্রিয়ভাবে বন্ধ হয় না, মানে ‘সেশন আউট’ নেই এতে। এ ছাড়া পাসওয়ার্ড সুরক্ষায় ওটিপি (ওয়ান টাইম পিন) ব্যবস্থাও নেই। এসব কারণে বা সিস্টেমে ত্রুটির সুযোগ নিয়ে হ্যাকাররা অতিরিক্ত মহাপরিচালকের আইডি ব্যবহার করার সুবিধা নিয়ে বাতিল কার্ড অনুমোদন করেছে।
এই পরিস্থিতিতে জালিয়াতি বন্ধে সার্ভার সরিয়ে নিচ্ছে বিএমইটি। বর্তমান সার্ভারটি বিএমইটির কার্যালয়ে আছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এখানে এর সুরক্ষা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। আর এটি অনেক পুরনো সফটওয়্যার ব্যবস্থাপনায় চালানো হয়। তাই চাইলেও জালিয়াতি বন্ধ করা যাচ্ছে না, জড়িত কাউকে শনাক্ত করা যায় না। তাই আধুনিক ব্যবস্থাপনায় বিএমইটির সার্ভার ব্যবস্থাপনা বিসিসির কাছে স্থানান্তর করা হচ্ছে। এরই মধ্যে তিন ভাগের এক ভাগ তথ্য সরানো হয়ে গেছে। শিগগিরই পুরো কাজ শেষ হতে পারে বলে আশা করছে বিএমইটি।
এ বিষয়ে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের প্রবাসীকল্যাণ ডেস্কের সহকারী পরিচালক দেবব্রত ঘোষ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এখন প্রবাসী অ্যাপে বিএমইটি কার্ড জালিয়াতির ঘটনা বেড়েছে। অসাধু চক্র অন্যের ছবির জায়গায় ভুক্তভোগীদের ছবি ব্যবহার করে প্রতারণা করছে। সম্প্রতি বিমানবন্দরের প্রবাসীকল্যাণ ডেস্কে প্রতিনিয়ত এ রকম সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছি আমরা।’
তিনি আরও বলেন, ‘বিএমইটি অনলাইনে থাকা তথ্যের সঙ্গে বিদেশগামীদের কারও কারও ক্ষেত্রে তথ্যের মিল পাওয়া যাচ্ছে না। এতে তারা বিদেশে যেতে পারছে না। অনেক দালাল টাকার বিনিময়ে এসব ভুয়া কার্ড বানিয়ে বিদেশগামী প্রবাসীদের সঙ্গে প্রতারণা করছে। পরে এসব কার্ড আমরা বিএমইটির কাছে পাঠিয়ে দিচ্ছি। তারা তদন্ত করে বিষয়গুলো সম্পর্কে ব্যবস্থা নিচ্ছে। কয়েক দিনে আমরা এ-সংক্রান্ত বেশ কয়েকটি অভিযোগ পেয়েছি।’
এ বিষয়ে জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো আইটি শাখার ইন্সট্রাক্টর (আইএমইটি) মো. সাইফুল ইসলাম মামুন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সম্প্রতি এ-সংক্রান্ত কোনো অভিযোগ আমরা পাইনি। কিছুদিন আগে এ রকম অভিযোগ ওঠার পর কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নেয়। এখন স্মার্ট কার্ড জালিয়াতের ঘটনা হলে তা খতিয়ে দেখা হবে। তবে কিছু অসাধু মানুষ বিদেশগামীদের সঙ্গে প্রতারণা করে যাচ্ছে। তারা বিভিন্ন পন্থা অবলম্বন করে বিএমইটি স্মার্ট কার্ড জালিয়াতি করছে।’
সম্পাদক মন্ডলীর সভাপতিঃ সাঈদুর রহমান রিমন। প্রকাশক ও সম্পাদক ফয়সাল হাওলাদার। বার্তা- সম্পাদক জুয়েল খন্দকার। প্রধান কার্যালয়ঃ- ৩৮/১ আরামবাগ.(মতিঝিল) ঢাকা-১০০০। ইমেলঃ- bdccrimebarta@gmail.com, মোবাঃ ০১৭৩২৩৭৯৯৮২
ইপেপার