মোর্শেদ মারুফ, ময়মনসিংহ থেকে ফিরে: ময়মনসিংহ জেলা এবং পাশ্ববর্তী উপজেলায় সরকারি দপ্তরে কর্মরত একশ্রেণির দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা এবং কর্মচারিদের অনিয়মে উপার্জিত বিপুল অংকের কালো টাকায় জমি ক্রয়ের মাধ্যমে বহুতল ভবন নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে কোটি কোটি টাকা। এসব ব্যাক্তিরা স্থানীয় ভাবে বিত্তশালী হিসাবে পরিচিত। সেই সুবাদে ময়মনসিংহ শহরের গোলকিবাড়ি এখন অভিজাত এলাকা। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের প্রধান সহকারি, উপজেলা সহকারী যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা, সমবায় কর্মকর্তা, ভূমি সহকারী কর্মকর্তা,ইউনিয়ন পরিষদ সচিব, শিক্ষক, পুলিশ অফিসারসহ ময়মনসিংহ জেলা ও বিভাগীয় অফিসের এক শ্রেণির দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা ও ৩য় শ্রেণীর কর্মচারীরা এখন বিপুল সম্পদের মালিক। নিজ এলাকায় জমি ক্রয় কিংবা বাড়ি ঘর নির্মাণ করলে প্রতিবেশিদের কাছে দুর্নীতির কালো টাকার উৎস ফাঁস হয়ে যাবে এই আশঙ্কায় স্থানীয় ভয়ে কিছু করতে সাহস পাচ্ছেন না।
দুর্নীতি ও লুটপাটের মাধ্যমে অর্জিত টাকা দিয়ে ময়মনসিংহ শহরের গোলকিবাড়ি এলাকায় নামে- বেনামে জমি ক্রয়ের মাধ্যমে বিলাসবহুল বহুতল ভবন নির্মাণ করে এবং তাদের স্বপ্নের বাড়িতে স্ত্রী- সন্তানদের নিয়ে আয়েশি জীবনযাপন করছেন। বিডিসি ক্রাইম বার্তার অনুসন্ধানে বেড়িয়ে এসেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। অনুসন্ধানে জানা গেছে, মুক্তাগাছা সহকারী যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা শাহীন আলম, ময়মনসিংহ জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের প্রধান সহকারি এনামুল হক, ভালুকার সমবায় কর্মকর্তা মঞ্জুরুল ইসলাম,জামালপুরের ভূমি সহকারি কর্মকর্তা (নায়েব) আব্দুল গনি, নান্দাইল ইউনিয়ন পরিষদ সচিব শাহীন আলমসহ কয়েকজন স্কুল শিক্ষক মিলে ১৬ জন এই রাজ বাড়ি গড়ে তুলেন।
তাদের বিষয়ে অনুসন্ধান করেন প্রতিদিনের কাগজ অনুসন্ধানী টিম । শহরের গোলকিবাড়ি এলাকায় এই সিন্ডিকেট প্রথমে ৩ কোটি টাকায় ৬ শতাংশ জমি ক্রয় করেন। এরপর আরো প্রায় ৮ কোটি টাকা নির্মাণব্যয়ে গড়ে তুলেন ১১ তথা বিশিষ্ট বহুতল ভবন। সবশেষে ১৬ জনে প্রায় ১১ কোটি টাকা ব্যয় করেন। তারা কোথায় পেলেন এত টাকা। খোঁজ নিয়ে এবং এলাকাবাসীর সাথে কথা বলে জানা যায়, এই এলাকায় তাদের মত আরো কয়েকজনের আলিশান বাড়ি রয়েছে। গোলকিবাড়ি এলাকায় এখন অভিজাত এলাকা। এই এলাকায় কমপক্ষে ১০/১২ টি আলিশান ভবন নির্মাণ করেছেন অনেকেই। তাদের বেতনের টাকায় কোনোমতে জীবন ধারণের কথা। তারা একেক জন যেন টাকার কুমির। নিজেদের আলিশান বাড়ি দেখতে নিয়ে আসেন বিলাসবহুল গাড়ি। যুগের পর যুগ এরা ঘুরে ফিরে একই স্থানে বহাল তবিয়তে । ময়মনসিংহ জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের প্রধান সহকারি এনামুল হক দীর্ঘদিন একই কর্মস্থলে থেকে শিক্ষক নিয়োগ, বদলি, পদায়ন, শিক্ষকের এমপিওভুক্তি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অনুমোদন, জাতীয়করণ,অবসরের পর পেনশনের টাকা তোলা নিয়ে ঘুষ দুর্নীতি করেন অবাধে।
এ ছাড়াও নাম, বয়সসহ নানা বিষয় সংশোধন, টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড পেতে তার অফিস থেকে ফাইল পাঠাতে মোটা অংকের টাকা ঘুষ নেন। আরেক সিন্ডিকেট সদস্য মুক্তাগাছা সহকারি যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা শাহীন আলম । ঘুষ, দুর্নীতি অনিয়মের মহোৎসবে মত্ত থাকেন। তিনি বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণের জন্য প্রথমে নামের তালিকা বানান। নির্ধারণ করেন প্রশিক্ষণের স্থান, নাম। তৈরি করা হয় প্রকল্প।প্রকল্প গুলো অনুমোদন হয়। এরপর অফিসের চেয়ার-টেবিলে বসে শেষ করেন প্রশিক্ষণ। প্রশিক্ষণার্থীদের নামে ইস্যু করা সনদপত্র গায়েবি বিতরণ করেন । শাহীনের বিরুদ্ধে অনিয়ম, দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ দীর্ঘদিনের। তার অনিয়ম, দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার কারণে সরকারের গৃহীত কোনো প্রদক্ষেপ আলোর মুখ দেখছে না দীর্ঘদিন ধরে।
একই কর্মস্থলে দীর্ঘদিন কাজ করার সুবাদে স্থানীয় মধ্যস্বত্বভোগীদের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তোলেন। এ সখ্যতাকে পুঁজি করে যুব মহিলা ও যুবকদের মিথ্যা স্বপ্ন দেখিয়ে অবৈধভাবে আর্থিক সুযোগ নিচ্ছেন। কর্মস্থলে অনিয়মিত থেকে বেশির ভাগ সয়মই গোলকিবাড়ি বহুতল ভবন নিজ প্রকল্প এলাকায় ব্যস্থ থাকেন। কিন্তু হাজিরা খাতায় একদিনেই গোটা মাসের হাজিরা দিয়ে চলে যান। দীর্ঘদিন যাবৎ মনগড়া অর্থাৎ নিজের ইচ্ছামত কার্যক্রম পরিচালনা করেন। উপজেলার বেকার যুব মহিলা ও যুবকরা তার কম্পিউটার, সেলাই, ফসল চাষাবাদ, গবাদিপশু পালনসহ নানান প্রশিক্ষন বচ্ছিত। অথচ সরকারিভাবে এখাতে বরাদ্দ হলেও তা ব্যয় কিনা প্রশ্ন উঠেছে। সিন্ডিকেট সদস্য জামালপুরের ভূমি সহকারি কর্মকর্তা আব্দুল গনি ঘুষ ছাড়া কাজ করেন না। ভূমিহীনদের জমি বরাদ্দ দেওয়ার নামে, জমির মিউটেশন, খাজনার টাকা বেশি আদায় করে কম টাকার রশিদ প্রদান, বাজারের ভিটি বরাদ্দের নামে টাকা নেওয়া এবং অর্পিত সম্পত্তি অবমুক্ত করে দিতেও মোটা অংকের টাকা ঘুষ নেন তিনি।
জামালপুর জেলা প্রশাসকের দপ্তর থেকে ভূমিহীনদের নাম অনুমোদন হয়ে আসার পর জমির কবুলিয়ত দলিল করে দিতে টাকা লাগে তার কাছে । এছাড়ও বিভিন্নভাবে তিনি টাকা আদায় করেন সাধারণ মানুষের কাছ থেকে। গোলকি বাড়ি এলাকার অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক আজিজুল মাস্টার জানান, আমি ৩৬ বছর প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষকতা করেছি, দুটি ছেলে ও একটি মেয়েকে উচ্চশিক্ষিত করেছি। কিন্তু তাদের জন্য কোন সম্পদ রেখে যেতে পারবো না। আজ আমার এলাকায় ময়মনসিংহ জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের সামান্য একজন কেরানিসহ কয়েকজন মিলে ১১ তলা বিশিষ্ট আলিশান বাড়ি নির্মাণ করেন। আমি জানিনা তারা এত টাকা কোথায় থেকে পেলেন। সামান্য একজন সরকারি কর্মচারী হয়ে এত টাকার মালিক হওয়া আমার কাছে স্বপ্ন মনে হচ্ছে। তাদের সম্পর্কে আরও খোঁজ নেন।
অবসরপ্রাপ্ত নৌবাহিনীর সৈনিক ইকবাল করিম চৌধুরী জানান, এই ১১তলা বিশিষ্ট বিল্ডিং টা খুব দ্রুতগতিতে কাজ সম্পন্ন করেছেন। আমি শুনেছি কয়েকজন সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারী নির্মাণ করেছেন। তারা এত টাকার মালিক কেমনে হলেন আমার মাথায় কাজ করে না। তবে শুনেছি কিছুদিন আগে দুদকের একটি টিম তাদের সম্পর্কে খোঁজ- খবর নিয়েছেন। ময়মনসিংহের যুব উনয়নের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বলেন, ময়মনসিংহ যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের ন্যাশনাল সার্ভিস কর্মসূচি প্রকল্পে কর্মরত থেকে কয়েকজন কর্মকর্তা কর্মচারী ময়মনসিংহ শহরে নামে- বেনামে কোটি কোটি টাকার জমি- প্লট ক্রয় করেছেন।
সম্পাদক মন্ডলীর সভাপতিঃ সাঈদুর রহমান রিমন। প্রকাশক ও সম্পাদক ফয়সাল হাওলাদার। বার্তা- সম্পাদক জুয়েল খন্দকার। প্রধান কার্যালয়ঃ- ৩৮/১ আরামবাগ.(মতিঝিল) ঢাকা-১০০০। ইমেলঃ- bdccrimebarta@gmail.com, মোবাঃ ০১৭৩২৩৭৯৯৮২
ইপেপার