বনি আমিন, কেরানীগঞ্জ থেকেঃ চাঞ্চল্যকর ১০-ম শ্রেনীর মেধাবী ছাত্র ইজিবাইক চালক শাকিল (১৮)- এর ক্লু-লেস হত্যাকান্ডের রহস্য উদঘাটন, হত্যাকান্ডে জড়িত ৪ জন আসামিকেই গ্রেফতার, হত্যায় ব্যবহৃত রক্ত মাখা চাকু ও অন্যান্য আলামত উদ্ধার করেছেন দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানা পুলিশ। গত ১৯ মে সকাল অনুমান ৬.০০ ঘটিকার সময় ঢাকা জেলার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানাধীন মঠবাড়ী পদ্মা রেলওয়ে সেতুর নিচে সাবেক চেয়ারম্যান গিয়াস উদ্দিন এর পরিত্যক্ত ইটের খোলার ভিতরে একজন ছেলের গলা কাঁটা লাশের সংবাদ পেয়ে দক্ষিণ কেরাণীগঞ্জ থানা পুলিশ দ্রুত ঘটনাস্থলে গিয়ে মৃত দেহটি উদ্ধার করে এবং ঘটনাস্থলে গিয়ে জানতে পারে নিহত ব্যাক্তিটি একই ইউনিয়নের জাজিরা গ্রামের মৃত সিদ্দিক মিয়ার ছেলে শাকিলের (১৮)।
ঘটনাস্থলে উপস্থিত শাকিলের পরিবারের সদস্যরা লাশটি শাকিলের মর্মে সনাক্ত করে এবং পুলিশকে জানায় যে, শাকিল ১০-ম শ্রেণীর ছাত্র, তার বাবা ছোটবেলায় মারা যায়, বাসায় শাকিল তার অসুস্থ মা ও ছোট ভাইকে নিয়ে থাকতো। নিজের পড়াশুনা, মায়ের চিকিৎসা ও সংসারের খরচ মিটানোর জন্য শাকিল স্কুল শেষে প্রতিদিন বিকেল হতে রাত ১০ টা পর্যন্ত ইজিবাইক চালায়। শাকিলের পরিবার জানায় প্রতিদিনের মতো শাকিল গত ১৮ মে ২০২৩ খ্রি: তারিখ বিকেল বেলায় তার ইজিবাইক নিয়ে বের হলেও রাতে আর বাসায় ফিরে আসেনি।
পুলিশ মৃতদেহের সুরতহাল রিপোর্ট প্রস্তুত করার সময় দেখতে পায় যে, মৃত শাকিলের গলা ধারালো অস্ত্র দ্বারা জবাই করে মাথা দেহ থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়েছে এবং পিঠে এলোপাথাড়ি ১১ টি চাকু মারার ক্ষত আছে এবং পেটের ডান পাশে চাকু মারার ফলে নাড়ি ভুড়ি বের হয়ে গিয়েছে। সুরতহাল শেষে পুলিশ শাকিলের মৃতদেহ ময়না তদন্তের জন্য মিটফোর্ড হাসপাতালের মর্গে প্রেরন করেন।
এ ঘটনায় পরবর্তীতে শাকিলের বড় বোন সীমা (২৪) বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা আসামীদের বিরুদ্ধে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলা নং- ৯৫, তাং- ২০ মে ২০২৩ খ্রিঃ, ধারা- ৩০২/৩৭৯/৩৪ পেনাল কোড এই নুশংস হত্যাকান্ডের সংবাদ পাওয়ার সাথে সাথে হত্যাকান্ডের মূল রহস্য উদঘাটন ও ঘটনায় জড়িত আসামীদের দ্রুত গ্রেফতার করার জন্য আসাদুজ্জামান, পিপিএম- বার, পুলিশ সুপার ঢাকা, মহোদয় তাৎক্ষনিক নির্দেশ প্রদান করেন।
এরই ধারাবাহিকতায় আমিনুল ইসলাম, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস্-দক্ষিণ) এর সার্বিক দিক-নির্দেশনায় এবং শাহাবুদ্দিন কবীর, বিপিএম, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, কেরাণীগঞ্জ সার্কেল এর নেতৃত্বে একটি স্পেশাল তদন্ত টিম নৃশংস এই ক্লু-লেস হত্যাকান্ডের মূল রহস্য উদঘাটনের লক্ষ্যে ঘটনার পর থেকেই ব্যাপক তদন্ত কার্য়ক্রম শুরু করেন।
ক্রাইমসিন হতে তদন্ত টিম প্রাথমিক ভাবে ধারনা করে যে, অজ্ঞাতনামা আসামীরা ইজিবাইক ছিনতাই এর উদ্দেশ্যে শাকিলকে নির্জন পরিত্যক্ত ইট খোলায় নিয়ে নৃশংস ভাবে হত্যা করেছে। তদন্ত টিম ঘটনা স্থল ও এর আশেপাশের এলাকায় তথ্য- প্রযুক্তির সর্বোত্তম প্রয়োগ করে হত্যাকান্ডে জড়িত আসামীদের সনাক্ত করতে সক্ষম হয়। প্রযুক্তিগত তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, আসামীরা ইতিমধ্যে মোবাইল বন্ধ করে বিভিন্ন জেলায় পালিয়ে গেছে।
এমতাবস্থায়, হত্যাকান্ডে জড়িত আসামীদের দ্রুত গ্রেফতারের লক্ষ্যে শাহাবুদ্দিন কবীর, বিপিএম, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, কেরাণীগঞ্জ সার্কেল এর সরাসরি তত্ত্ববধানে এবং শাহজামান, অফিসার ইনচার্জ, দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানা এর সার্বিক সহযোগিতায় মাসুদুর রহমান (ইন্সঃ) তদন্ত দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানা এর নেতৃত্বে।
একটি চৌকষ আভিযানিক দল টানা ২৪ ঘন্টা ধারাবাহিক অভিযান পরিচালনা করে নৃশংস এই হত্যাকান্ডে জড়িত আসামী ১) ইব্রাহিম চান (২১)-কে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা হতে, ২) শারফাত (২০)-কে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ হতে, ৩) সাব্বির হোসেন মেহেদী (২২)-কে ধামরাই হতে এবং ৪) জনি (২০)-কে সাতক্ষীরা হতে গ্রেফতার করে।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে ধৃত আসামীরা হত্যাকান্ডের কথা স্বীকার করে এবং পরবর্তীতে আসামীদের স্বীকারোক্তি ও দেখানো মতে হত্যাকান্ডে ব্যবহৃত একটি রক্তমাখা সুইসগিয়ার চাকু, আসামীদের ব্যবহৃত রক্তমাখা সিএনজি ও লুন্ঠিত ইজিবাইকটি পুলিশ উদ্ধার করতে সক্ষম হয়।
ধৃত আসামিরা সবাই মাদকাসক্ত এবং কিশোর গ্যাং-এর সক্রিয় সদস্য। আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, গত ১৮ মে ২০২৩ খ্রি: তারিখ আসামিরা একটা ইজিবাইক ছিনতাই করে তার ব্যাটারী বিক্রির টাকা দিয়ে মদের পার্টি করবে মর্মে পরিকল্পনা করেছিল। সেই পরিকল্পনা মোতাবেক ঐদিন সন্ধ্যায় আসামিরা ইব্রাহিম চানের সিএনজি নিয়ে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের কাউটাইল ঘাটে টার্গেট ইজিবাইকের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে।
পরবর্তীতে কোন টার্গেট ইজিবাইক না পেয়ে শরাফত ও জনি কাউটাল ঘাট এলাকা থেকে সামনে এগিয়ে গিয়ে শাকিলকে পায়। শাকিল জনির পূর্ব পরিচিত বিধায় শাকিলকে নির্জন জায়গায় ভাড়া করে নিয়ে যাওয়া সহজ হবে মনে করে আসামিরা শাকিলের ইজিবাইক টা ভাড়া করে। জনি, শারফাত এবং সাব্বির শাকিলের ইজিবাইকে উঠে ঘুরতে ঘুরতে শাকিলকে নিয়ে মঠবাড়ী পরিত্যক্ত ইটখোলায় যায়।
অপরদিকে ইব্রাহিম চান সিএনজি নিয়ে ওদের পিছু পিছু আসে। তারপর ঘটনাস্থলে পৌঁছানো মাত্রই পূর্বপরিকল্পনা মাফিক শরাফাত সুযোগ বুঝে সুইসগিয়ার দিয়ে শাকিল এর গলায় পাড় দেয়। এতে শাকিল ইজিবাইক থেকে পড়ে যায় এবং গলা চেপে ধরে চিৎকার শুরু করে। তখন জনি পেছন থেকে শাকিলের পিঠে এলোপাথাড়ি চাকু মারতে থাকে। কিন্তু তারপরও শাকিল চিৎকার ও দাপাদাপি করতে থাকলে জনি, সাব্বির এবং ইব্রাহিম চান শাকিলের মাথা ও হাত-পা চেপে ধরে এবং শরাফাত শাকিলকে সুইসগিয়ার দিয়ে মাথার সামনে- পেছনে জবাই করে মাথা প্রায় বিচ্ছিন্ন করে ফেলে।
মৃত্যু নিশ্চিত করার পর শরাফত, জনি ও ইব্রাহিম চান সিএনজিতে করে চলে যায় এবং সাব্বির ওদের পেছন পেছনে মৃত শাকিলের ইজিবাইক চালিয়ে ঘটনা স্থল থেকে সটকে পড়ে। মূলত আসামীদের মদের পার্টির টাকার জন্যই তারা পূর্ব পরিচিত ইজিবাইক চালক শাকিলকে হত্যা করে তার ইজিবাইক ছিনতাই করে। মামলার তদন্ত অব্যাহত আছে।