উত্তর দেয়ার কোনো সময় আমাকে না দিয়ে একের পর এক চারপাশ থেকে এগিয়ে আসা সেনাবাহিনীর বুট পরা পা গুলো আমাকে ফুটবলের মত লাত্থি দিতেই থাকে। একসময় আমি জ্ঞান হারাই। যখন জ্ঞান ফেরে তখন কানে ভেসে আসছিলো- ‘ছোটো খাটো মানুষ, সব সত্য বলে দিবে। আর টর্চারের দরকার নাই।’ অন্যরা তখন বলছিলো- ‘স্যার, তাহলে এখন কি করবো স্যার?’ উত্তরে ভারি কণ্ঠের একজন ব্যক্তি বলে ওঠে- ‘বুঝিয়ে বলো। সঠিক উত্তর না দিলে জানিও। আজ সারাদিন নিজেদের সবটুকু চেষ্টা চালিয়ে যাও।’
আমাকে কেবল মারপিটই করা হয়নি, নির্মমতার সবটুকু করেছে আমার সাথে তারা। যেভাবে বন্দি করে রাখা হয় এবং যে পরিবেশে রাখা হয় সেটা ভাষায় অত্যন্ত অমানবিক এবং ভয়ংকর রকমের মানসিক অত্যাচার। যেভাবে তারা রাখে এটাতো অত্যন্ত অমানবিক। এটাতো মানুষের বসবাসের জায়গা না। মানুষ এভাবে বাঁচে না। এটাতো কবরের মতো।
কোনো জানালা নেই, বাতাসের ছিটেফোটাও নেই। বদ্ধ ঘরের মধ্যে দ্বিতীয় দফায় আমাকে আবারো টর্চারের প্রস্তুতি নিতে নিতে নিতে তারা আমার মুখে গরম পানি এনে ঢেলে দেয় এবং বলে- ‘ঘুম কি ভাঙছে! নতুনধারার রাজনীতির প্রবর্তক মোমিন মেহেদী।’ বলে হো হো করে হেসে ওঠে শেয়ালের মত করে। আমার মুখ-চোখ ঢাকা থাকলেও তারা সেই অবস্থাতেই প্রশ্ন অব্যাহত রাখে- ‘রাজনীতি করছেন, টাকা কে দিচ্ছে? কার বা কাদের টাকায় প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে কথা বলছেন?’এত চর্টার করছিলো যে, আমি মুখ খোলারও সময় পাচ্ছিলাম না। তারা তাদের হায়েনাগিরি করেই যেতে থাকে। এমন নির্মমতার কাহিনী শুধু গল্পে-উপন্যাসে পরেছি, সিনেমাতে দেখেছি; বাস্তবে যে আমিই এমন নির্মমতার মুখোমুখি হবো, তা কল্পনাও করিনি। আমাকে যে রুমে নির্যাতন করা হচ্ছে, সে রুমে ছিলো কমপক্ষে ১০ জন। কিন্তু লাত্থি দিচ্ছিলো ৫/৬ জন। খাবার তো দেয়া হয়-ইনি, পানি চাইলে তারা আরো কঠিনভাবে-ভয়াবহভাবে মাথায় ও পায়ের পাতায় মারতে থাকে। প্রথম দিন নাকি দ্বিতীয় বলতে পারবো না, কিভাবে যে কেটেছে দুঃখসময়, তা কেবলই আল্লাহ তা’য়ালা জানেন। দ্বিতীয় দফায় জ্ঞান হারানোর পর তারা আমাকে নিয়ে যায় একটা নোংরা টয়লেটে, বলে- ওয়াশরুম-এর কাজ সেরে নিতে। হাত খুলে দিতে বললে, তারা আমার হাত খুলে দিয়ে টয়লেটের হাই কমোড-এ বসিয়ে দেয়। চোখ বন্ধই থাকে আগের মত। জম টুপি পড়া আমি কোনোমতে পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন হতেই শারিরীক দূর্বলতার কারণে পিছলে পরে যাই। যারা আমাকে তুলে নিয়েছিলো, তাদের কোনো রকম মানবতাই ছিলো না। ছিলো কেবল হায়েনার মত হামলা আর আঘাতের চিন্তা। প্রশ্ন একটা করে ১ শত বার টর্চারের মুখোমুখি করা হচ্ছে। এক পর্যায়ে তারা আমার লম্বা চুলগুলোকে ফেলে দেয়, যা টের পাই চতুর্থ দফায় জ্ঞান ফেরার পর। ততক্ষণে জমটুপি খুলে তারা আমার চোখ বেঁধে রেখেছে কালো কস্টিপ দিয়ে। ঘুরেফিরে ৪-৫টি বন্দিশালায় আমাকে রাখা হয়। এসব বন্দিশালায় আরো মানুষ ছিলো কি না তা দেখার সুযোগ আমার হয়নি, তবে অনুমান করতে পেরেছি, অনেক মানুষ হিসহিস ফিসফিস করে কথা বলছিলো। তারা কি বন্দী নাকি সেনা সদস্য নাকি অন্য কেউ বুঝতে পারিনি।
একদিন একটি ভারি কন্ঠের মানুষ আমার পায়ের উপর বুট পরা পা দিয়ে চাপ প্রয়োগ করে প্রশ্ন করতে থাকেন- ‘ কাদের টাকায় রাজনীতি করছেন, টাকা কে দিচ্ছে? কার বা কাদের টাকায় প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে কথা বলছেন?’
আমি ব্যথায় কাতর কন্ঠে উত্তর দেই- ‘নতুনধারার নেতাকর্মীদের টাকায় আমরা রাজনীতি করছি। আর প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে নয়, কথা বলছি- অন্যায়ের বিরুদ্ধে।’ উত্তর শেষ হওয়ার আগেই হায়েনার মত আমাকে লোহার রড দিয়ে আঘাত শুরু করে কয়েকজন। এমন নির্মম হামলায় আমি আবারো আমি জ্ঞান হারাই।পঞ্চম দফায় জ্ঞান ফেরার পর বুঝতে পারি- একজন চিকিৎসক এসেছেন। তিনি আমার প্রেসার মাপেন এবং খাবার দেয়ার জন্য অনুরোধ জানিয়ে বলেন, তার অবস্থা খুব খারাপ, যে কোন সময় মৃত্যুবরণ করতে পারেন। এমন কথা শুনে কিছু সময়ের জন্য নিরব হয়ে যায় পুরো রুমটি। যেহেতু চোখ এবং হাত বাঁধা, সেহেতু তারা আমার হাত খুলে দেয়ার সিদ্ধান্তের কথা জানায়। হাত খুলে দিয়ে আমার সামনে খাবার রাখে কিন্তু সেই খাবার হাত দিয়ে তুলে মুখ দেয়ার ক্ষমতা আমার নেই বলতেই এক ব্যক্তি চামচ দিয়ে মুখে খাবার তুলে দিলেন। ৩/৪ চামচ খাবার থেতে না খেতেই সেই ভারি কন্ঠের ব্যক্তি এসে আবারো প্রশ্ন করে- ‘র’-এর কারো সাথে যোগাযোগ আছে? আমি বললাম- ‘র’-এর একজন কর্মকর্তা এসেছিলেন, কিন্তু তাঁর সাথে আমার কোনো যোগাযোগ হয়নি।’
কেন এসেছিলো? বললাম- ‘রাজনৈতিক দলের অবস্থা সম্পর্কে ধারণা নিতে।’ আইএস-এর কর্মকর্তার সাথে গত ১১ ফেব্রুয়ারি যে বৈঠক করেছেন, কেন করেছেন?
বললাম- ‘এমন কোনো বৈঠক হয়নি। ’উত্তর মনোঃপুত না হওয়ায় আবারো টর্চার শুরু হয়। এতে আমি আবারো জ্ঞান হারাই। যখন জ্ঞান ফেরে, তখন নিজেকে আমি হাসপাতালের বেডে আবিস্কার করি। এই সময়ে নতুনধারা বাংলাদেশ এনডিবির প্রতিটি নেতাকর্মীর মুখ ভেসে উঠতে থাকে। চোখের সামনে ভেসে ওঠে বারবার আমার সহধর্মীনি শান্তা ফারজানার মুখ। যতবার টর্চারের মুখোমুখি হচ্ছিলাম, ততবার ভাবছিলাম- ‘এই বুঝি আমাকে তারা হত্যা করে ফেলবে।’এমন নির্মমতার পর জানতে পারি- নতুনধারা বাংলাদেশ এনডিবির নেতাকর্মীদেরকে সাথে নিয়ে শান্তা ফারজানা, আহমেদুল কবির খান কিরণ, ডা. নূরজাহান নীরা, মাহমুদ হাসান তাহের, মনির জামানসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ থানায় জিডি, ডিবি অফিসে অভিযোগ, জাতীয় প্রেসক্লাবে অনশন, ফেরত দেয়ার দাবিতে বিক্ষোভ সমাবেশসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে।
এটা সত্য যে, আমার হাসিনার আমলে, সাংবাদিক, রাজনৈতিক বিরোধী, সমাজকর্মী, আইনজীবী, শিক্ষার্থী, ব্যবসায়ী, সেনাকর্তা থেকে শুরু করে, বহু মানুষকে গুম করা হয়েছে। বিনা বিচারে আটকে রাখা হয়েছে এখানে। আসলে, আয়নাঘর হল বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা দফতর বা ডিজিএফআই-এর আওতাধীন এক গুপ্ত গুম ঘর।গুপ্ত গুম ঘরেটির কোডনেম ছিল আয়নাঘর।কীভাবে এই কোডনেম এল তা স্পষ্ট নয়। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য শেখ হাসিনা অনেক প্রচেষ্টা করেছিলেন। গত পনেরো বছরের বেশি সময় দেশের মাথা পিছু আয়ের ব্যাপক বৃদ্ধিতে স্পষ্ট, তাঁর সেই চেষ্টা কাজেও দিয়েছিল। সেই সঙ্গে হাসিনা জোর দিয়েছিলেন পরিকাঠামো উন্নয়নে কিন্তু, তাঁর বিরুদ্ধে সবথেকে বড় অভিযোগ ছিল, হাসিনা স্বৈরাচারী। কোনও ধরনের বিরোধিতা তিনি সহ্য করতে পারতেন না।তাঁর আমলে,সাংবাদিক,রাজনৈতিক বিরোধী, সমাজকর্মী, আইনজীবী, শিক্ষার্থী, ব্যবসায়ী, সেনাকর্তা থেকে শুরু করে, বহু মানুষকে গুম করা হয়েছে।বিনা বিচারে আটকে রাখা হয়েছে বলে,অভিযোগ ছিল। ঢাকার মানবাধিকার সংগঠন, অধিকার-এর এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৪ থেকে ২০১৯ সালের জুলাই মাস পর্যন্ত, বাংলাদেশ সরকারের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ মদতে, সেই দেশে প্রায় ৩৪৪ জন ব্যক্তিকে গুম করা হয়েছিল। পরে, তাদের মধ্যে ৪০ জনকে মৃত অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল। সরকারি হেফাজতে পাওয়া গিয়েছিল ৬৬ জনকে। আরও ২০৩ জন ছিলেন নিখোঁজ। তাঁরা কোথায়,কেউ জানত না।
এদের অনেকেই আয়নাঘরে বন্দি ছিল বলে মনে করা হয়। বিচার বহির্ভূতভাবে আটকে রাখা এবং হত্যার এই সকল ঘটনা নিয়ে, সময়ে সময়ে হাসিনা সরকারের নিন্দা করেছে রাষ্ট্রপুঞ্জ এবং অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালে’র মতো বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা। ১০ বছর ধরে আটক থাকা ৮৬ জনের নামের একটি তালিকাও প্রকাশ করেছিল হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। দীর্ঘদিন পর্যন্ত এই আয়নাঘরের অস্তিত্বর কথাও কেউ জানত না। ২০২২ সালে, নেত্র নিউজ নামে সুইডেনের এক সংবাদ সংস্থা এবং জার্মান সংবাদ সংস্থা ডয়চেভেল, পৃথক পৃথক ভাবে বাংলাদেশ প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা দফতরের এই গোপন বন্দিশালা নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। তাদেরকেই বলা যায় আয়নাঘরের ‘হুইশল ব্লোয়ার’। আজ পর্যন্ত খুব কম বন্দিই আয়নাঘর থেকে মুক্তি পেয়েছে। সামান্য কিছু বন্দিকে দীর্ঘ বিচার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। তবে, হাসিনা বাংলাদেশে থাকাকালীন, এই মুক্তিপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের কারও মুখ খোলার সাহস হয়নি। আরও কড়া শাস্তির ভয়ে তাঁরা মুখ বন্ধ রেখেছিলেন। যেভাবে বন্ধ রাখা হয়েছিলো আমার মুখ-কলম। সেভাবে বন্ধ ছিলো শত শত মানুষের মুখ-কলম; সেভাবে বন্ধ রাখতে না পারলে হাসিনা সরকারের পতন হতো আরো অনেক আগে। বিশেষ করে ২৮ জুন ২০২৪ সালের সকাল সাড়ে ১০ টা থেকে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে যে তান্ডব করেছিলো পুলিশ, সেই তান্ডবের পর নতুনধারা বাংলাদেশ এনডিবির নেতাকর্মীরা শ্লোগান তুলেছিলেন – ‘নতুনধারার অঙ্গীকার-দুর্নীতি থাকবে না আর’ ‘নতুনধারার অঙ্গিকার খুন-গুম থাকবে না আরৃ’ এই শ্লোগানের সত্যতা আমরা দেখতে চাই, দেখতে চাই খুন-গুমমুক্ত শুদ্ধ-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ…
মোমিন মেহেদী : চেয়ারম্যান, নতুনধারা বাংলাদেশ এনডিবি