• বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০২:৪৫ অপরাহ্ন
শিরোনাম:
আমরা এক পরিবার, কেউ কারো শত্রু হবো না: প্রধান উপদেষ্টা সীমান্তের বিএনপি নেতা সাবেক ইউপি সদস্যের ভাতিজা ইয়াবাসহ আটক আওয়ামীপন্থী পুলিশ কর্মকর্তাদের নামের তালিকায় ময়মনসিংহের ওসি সফিকুল ইসলাম ভাড়া বাড়িতে কলেজ ছাত্রের ঝুলন্ত লাশ, মৃত্যু নিয়ে ধোঁয়াশা যুবদল নেতা হত্যা মামলায় পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান বাবুল সরদার চাখারী কারাগারে তিন দিনের মধ্যে ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধের নির্দেশ তিতুমীর কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর: সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে হচ্ছে কমিটি, আন্দোলন স্থগিত গাজায় ইসরায়েলি হামলায় আরো অর্ধশত ফিলিস্তিনি নিহত সাবেক খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ৮ দিনের রিমান্ডে টাঙ্গাইলে বাস-পিকআপভ্যান সংঘর্ষে চারজন নিহত

ঠাকুরগাঁওয়ে সন্ধ্যা নামতেই অনলাইনে জুয়ার আসর

ঠাকুরগাঁও জেলা প্রতিনিধিঃ / ৭৪ পাঠক ভিউ
আপডেট সময় : বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর, ২০২৪

ঠাকুরগাঁও জেলা প্রতিনিধিঃ গ্রামের সবাই ‘খায়রুন সুন্দরী’ নামে ডাকেন উম্মে হুমাইরা সাইমাকে। এখনো চার বছর পূর্ণ হয়নি তার। এই বয়সেই যেতে হয়েছে ভয়াবহ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে। বাবা নিজের শরীরে পেট্রল ঢেলে আগুন ধরিয়ে আত্মহত্যা করেছেন, এরপর অন্যত্র বিয়ে করেছেন মা। বাবা- মা হারিয়ে এখন দাদির কাছে ঠাঁই হয়েছে ছোট্ট সাইমার। ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার আউলিয়াপুর ইউনিয়নের মাদারগঞ্জ গ্রামে দাদা শাহার আলী ও দাদি সাহেরা খাতুনের সঙ্গে বেড়ে উঠছে সাইমা। বাবা শফিকুল ইসলাম পেশায় ছিলেন অটো মেকানিক। সেই আয়ে বেশ স্বাচ্ছন্দ্যে চলতো পরিবারের ভরণপোষণ। পরে অর্থের লোভে অনলাইন জুয়ার (ক্যাসিনো) ফাঁদে পড়ে হারিয়েছেন সব পুঁজি। সর্বস্ব হারিয়ে করেছেন পাঁচ লক্ষাধিক টাকা ঋণ। ঋণের বোঝা সইতে না পেরে নিজের শরীরে পেট্রল দিয়ে আগুন লাগিয়ে আত্মহত্যা করেছেন তিনি। ঠাকুরগাঁও জেলা এভাবে অনলাইন জুয়ায় আসক্ত হয়ে সর্বস্বান্ত হয়েছে কয়েক হাজার পরিবার।

অর্থের লোভে পড়ে আসক্ত হচ্ছেন শিক্ষার্থী, তরুণ, দোকানি, শিক্ষক এমনকি চিকিৎসকও। জুয়ার নেশায় বুঁদ হয়ে সর্বস্ব হারাতে বসেছেন তাদের অনেকে। এতে বেড়েছে পারিবারিক অশান্তি ও দাম্পত্য কলহ। এ সুযোগে আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছেন অনলাইন জুয়া চক্রের ডিলাররা। ১০০ টাকা পকেটে থাকা ব্যক্তিও বনে গেছেন লাখ লাখ টাকার মালিক। চক্রের সঙ্গে জড়িত সবাইকে আইনের আওতায় এনে তরুণ ও যুব সমাজকে ধ্বংসের দ্বার প্রান্ত থেকে ফিরিয়ে আনার দাবি তুলেছেন স্থানীয় সচেতন মানুষেরা। সম্প্রতি মঙ্গলবার (১২ নভেম্বর) সরেজমিনে ঐ সব এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, অনলাইন জুয়ার ডিলারদের লোভনীয় অফারে আকৃষ্ট হয়ে সর্বস্ব হারাতে বসেছেন ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার আউলিয়াপুর ইউনিয়নের মাদারগঞ্জ, বোর্ড অফিস, সোনাহার, সেনপাড়া সহ কয়েকটি গ্রামের বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ। প্রত্যেকটি পরিবার থেকে কেউ না কেউ এ খেলায় যুক্ত হয়ে পথে বসেছেন। গ্রামগুলো যেন অনলাইন জুয়ার রাজধানীতে পরিণত হয়েছে। একাধিক ডিলারদের তত্ত্বাবধানে এ নেশায় আকৃষ্ট হয়েছেন গ্রামের সাধারণ মানুষ। যার ফলে পারিবারিকভাবে অশান্তি, বিবাহ বিচ্ছেদ, কলহ সহ ও পড়াশোনা বিমুখ হয়ে পড়েছেন শিক্ষার্থীরা।

অনলাইন জুয়ার ভয়াল এ থাবা থেকে মুক্তি পেতে প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন সাধারণ মানুষ। তবে অনলাইন জুয়া খেলে সর্বস্বান্ত হওয়া ভুক্তভোগীরা জানান, একদিকে অনলাইন জুয়ার নেশায় সাধারণ মানুষ সর্বস্বান্ত হলেও আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছেন জুয়া চক্রের ডিলাররা। আউলিয়াপুর ইউনিয়নের সেনপাড়া গ্রামের হেমন্ত সেন। দর্জি বিজ্ঞানের প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করছেন তিনি। কয়েক বছর আগেও পরিবারের খরচ চালাতে হিমশিম খেতেন। অথচ নিয়তির ঘুরপাকে অনলাইন জুয়ার ডিলার হয়ে পেয়েছেন আলাদীনের আশ্চর্য চেরাগ।

দুই লাখ টাকার মোবাইল সেট ও দামি ল্যাপটপ, চলাফেরা করেন চার লাখ টাকার মোটরসাইকেলে আর গ্রামে করেছেন দৃষ্টি জুড়ানো ফ্ল্যাট বাড়ি। কিছুদিন আগেও যাদের নুন আন্তে পান্তা ফুরানোর মতো অবস্থা ছিল তাদের এমন উত্থানে হতভম্ব এলাকার মানুষ। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অনলাইন জুয়ার সঙ্গে জড়িত একজন বলেন, অনলাইনে সহজেই এখন এসব জুয়া খেলা যায়। জুয়ার ডিলারের সঙ্গে যোগাযোগ করে খেলায় অ্যাকাউন্ট করতে হয়। পরে ডিলারের মাধ্যমেই টাকা তোলা যায় ও খেলায় টাকা লাগানো হয়। অনলাইন জুয়া খেলার অনেকগুলো সাইট আছে। অ্যাকাউন্ট করে বিকাশ, নগদ এর মাধ্যমে টাকা নিয়ে খেলায় টাকা লাগাতে হয়। লাভ হলে আবার বিকাশ, নগদ এজেন্ট এর মাধ্যমে টাকা তুলতে হয়। তবে এ খেলায় যারা ডিলার তারাই লাভবান হন। সাধারণ মানুষ যারা খেলেন, তারা প্রথমে লাভ দেখেন, পরে সর্বস্বান্ত হন।

এই এলাকায় যারা ডিলার আছেন তারা এখন সবাই লাখপতি। তারা আইনের ধরাছোঁয়ার বাইরে। এই এলাকায় অনেকগুলো ডিলার আছে অনলাইন জুয়ার। যেমন, কচুবাড়ি এলাকার তাপস চন্দ্র রায়, সাশলা মাদরাসা এলাকার বাদশা, মামুন, সোহেল, কচুবাড়ি দাঙ্গাপাড়া এলাকার বিকাশ রায়, রাসেল, শামিম, রোমানীসহ প্রায় শতাধিক। এছাড়া জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের ভূমি রেকর্ড রুমের বড়বাবু খ্যাত প্রধান উচ্চমান সহকারী সাইফুর রহমানও এর সঙ্গে জড়িত। জুয়া খেলেন ও ডিলার ছিলেন এমন আরেকজন পরিচয় গোপন রাখার শর্তে জানান, ডিলারদের কাছে অনলাইন ব্যাংকিং এর এজেন্ট সিম থাকে। সেই সিম থেকে টাকা লেনদেন হয়। প্রতিদিন এসব সিমে লাখ লাখ টাকা লেনদেন হয়। অনলাইন ব্যাংকিং এর যেসব ডিলার আছে তারা এসব জানে। তাদের কাছে এসব এজেন্ট সিম ভাড়া হিসেবে নিয়ে চালান জুয়ার ডিলাররা।

টাকা লেনদেন হলে ডিলারের লাভ হয়। তবে সাধারণ জুয়া খেলোয়াড় লাভ করতে পারেন না। প্রথমে খেলায় লাভের লোভ দেখানো হয়। সেই লোভে পড়েই জুয়া খেলোয়াড়রা ঝাঁপিয়ে পড়েন। আর মোবাইল দিয়ে খেলতে হয় তাই যেখানে ইচ্ছা খেলা যায়। ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলা বোর্ড অফিস এলাকার নুর ইসলাম বলেন, আমাদের এলাকার কম বেশি অনেকেই এই খেলার সঙ্গে জড়িত।

এরূপ সালন্দর ইউনিয়নে চলছে জুয়া খেলার আসর বিভিন্ন জায়গায় । সন্ধ্যার পরে যেখানে সেখানে কয়েকজন বসে এই জুয়া খেলার আসর বসায়। তবে তারা মোবাইলে খেলে সেজন্য কেউ তাদের ধরতে পারে না। এই এলাকার অনেকেই আজ সর্বস্বান্ত হয়ে গেছেন জুয়া খেলে।প্রশাসনও তেমন পদক্ষেপ না নেওয়ায় দিন দিন জুয়া খেলা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর যারা জুয়া খেলার ডিলার আছেন, তারা তো হঠাৎ আলাদিনের চেরাগ পাওয়ার মতোই অবস্থা। তবে দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে মানুষ আরও বেশি ধ্বংস হয়ে যাবে। গোপন সূত্র বলছে, অনলাইন জুয়া চক্রের ডিলারদের সঙ্গে যোগসাজশ রয়েছে অনলাইন মোবাইল ব্যাংকিং এর ডিস্ট্রিবিউটর ও সেলস অফিসারদেরও। দোকান না থেকেও এজেন্ট সিম দেওয়া, দৈনিক ও মাসিক ভাড়া নেওয়া ও ডিলারদের কাছে মাসোহারা নিয়ে থাকেন তারা।

ঐ এলাকার বিকাশ, নগদ, ফ্লেক্সিলোড ব্যবসায়ী রশিদুল ইসলাম বলেন, আমাদের এখানে বড় ব্যবসা না থাকায় তেমন লেনদেন হয় না। তবে যে এজেন্ট সিমগুলো অনলাইন জুয়ায় ব্যবহার করা হয় সেগুলোতে দিনে লাখ টাকারও বেশি লেনদেন হয়। তাই এই বিকাশ, নগদ ডিলাররা এজেন্ট সিমগুলো অনলাইন জুয়ার ডিলারদের না দিলে তারা সেভাবে লেনদেন করে খেলা পরিচালনা করতে পারবে না।

অনলাইন জুয়ার ডিলার অভিযোগে হেমন্ত সেনের খোঁজে তার বাড়িতে গেলেও তাকে পাওয়া যায়নি। তার স্ত্রী মিনাক্ষী সেনের কাছে মোবাইল নম্বর চাইতে গেলে রেগে ওঠেন তিনি। প্রতিবেদকের ক্যামেরা ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা ও প্রতিবেদন হলে মামলার হুমকিও দেন মিনাক্ষী সেন। এলাকার অনলাইন জুয়া চক্রের অন্যতম ডিলার হেমন্ত সেন। তার মাধ্যমেই বিস্তার হয়েছে এ সর্বনাশী নেশা। নগদ ও বিকাশের এজেন্ট সিম ব্যবহার করে লাখ লাখ টাকার মালিক বনেছেন হেমন্ত। তবে আগে অনলাইন জুয়ার সঙ্গে যুক্ত থাকলেও এখন অনলাইন খেলেন না বলে দাবি হেমন্তের মা যাত্রী রাণী সেনের। অনলাইন জুয়ায় মোবাইল ব্যাংকিং এর সিম ব্যবহার হয় এমন অভিযোগে অনলাইন মোবাইল ব্যাংকিংয়ের ঠাকুরগাঁও জেলার ডিস্ট্রিবিউটর ও কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কয়েক দফায় কথা বলার চেষ্টা করলেও প্রধান দপ্তরের অযুহাতে কথা বলতে রাজি হননি তারা।

ঠাকুরগাঁও জেলা পুলিশ সুপার শেখ জাহিদুল ইসলাম বিডিসি ক্রাইম বার্তাকে বলেন, মানুষকে গ্রাস করে ফেলে জুয়া। অনলাইন জুয়ার তেমন কোনো আইন নেই। সাধারণ জুয়ার আইনে তাদের আটক করতে হয়। সেজন্য অপরাধ অনেক বড় হলেও সহজেই পার পেয়ে যান অপরাধীরা। এছাড়াও অনলাইন জুয়া খেলা হয় মোবাইলে। সে জন্য সহজেই জুয়াড়িদের ধরাও যায় না। এ চক্রের সঙ্গে জড়িতদের আইনের আওতায় এনে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

বিস্তারিত...