সাঈদুর রহমান রিমনঃ চার প্যাকেট ভারতীয় বিড়িসহ এক দিনমজুরকে আটকের ভয়ংকর সাফল্য (!) দেখিয়েছে সুনামগঞ্জ জেলা পুলিশ। জেলার জামালগঞ্জ থানা পুলিশ ৪ প্যাকেট ভারতীয় সেখ নাসির উদ্দিন বিড়িসহ একজনকে গ্রেফতারের এ বিরল অভিযানটি চালায়।
সেই সাফল্যের বার্তা ছবিসহ ব্ল্যাক রিভার্স লেখা ঘুরে বেড়াচ্ছে জেলা পুলিশের ফেসবুক পাতায়, নিউজ ফিডে ফিডে। সেখানকার উৎসাহী পুলিশ সদস্যরা সেই নিউজ আমার ইনবক্সে পাঠিয়ে গালমন্দ করতেও দ্বিধা করেননি। এএসআই পদ মর্যাদার একজন লিখেছেন, ‘সাংবাদিক সাহেব, কিছুদিন আগে আপনি মনগড়া ভাবে সুনামগঞ্জের এসপি কে চোরাচালানের সহযোগী আর জেলার পুলিশকে অকর্মা উল্লেখ করে যা তা লিখেছিলেন। আজ আপনি কোথায় মুখ লুকাবেন?’
তিনি ভুলভাল বানানে আরো লিখেন যে, এ অভিযানকে শুধুমাত্র কয়েক প্যাকেট বিড়ি উদ্ধারের তৎপরতা হিসেবে দেখার কারণ নেই। বরং বুঝতে হবে এসপি স্যারের নির্দেশে জেলার সীমান্ত জনপদে নিয়মিত চিরুনি অভিযান চলে। সেখানে পুলিশের চোখ এড়িয়ে চার প্যাকেট কেন, এক প্যাকেট বিড়িও চোরাচালানের উপায় নাই।
দারুণ কথা, চমৎকার যুক্তি। তত্ত্বাবধায়ক অফিসারের প্রতি একজন পুলিশ সদস্যের ভক্তি, শ্রদ্ধা, বিশ্বস্ততায় রীতিমত প্রশংসাযোগ্যই বটে। আশা করি সুনামগঞ্জের পুলিশ সুপার আনোয়ার হোসেন সাহেব নিজেও মুগ্ধ হবেন। কারণ নিজের সম্মান পুনরুদ্ধারে পুলিশ সদস্যদের প্রাণপণ চেষ্টা দেখে তিনি আপ্লুত হওয়ারই কথা।
আসলে সুনামগঞ্জের এসপি হিসেবে যোগদানের পর থেকে অভিযোগ আর বিতর্ক যেন তার পিছু ছাড়ছেই না। কেন যেন তার রাশির সাথে জায়গাটির মিল হচ্ছে না। সেখানকার পাহাড়ি নদ-নদী থেকে বেপরোয়া পাথর উত্তোলন, শত শত ড্রেজার বসিয়ে, তীর ধ্বসিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকার অবৈধ বালু তোলা বাণিজ্য, সীমান্তে খোলামেলা চোরাকারবারের সুযোগ দেওয়া বাবদ মাসোহারা তো অনেক কর্তার টেবিলেই যাচ্ছে। এসব ব্যাপারে প্রকৃত দায়বদ্ধ থাকা জেলা প্রশাসন, ইউএনও, এসিল্যান্ড, বিজিবি, পরিবেশ অধিদপ্তরের আঞ্চলিক কর্মকর্তারা অলিখিত ইজারা দিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। অথচ তাদের ব্যাপারে কেউ কিছু বলেন না, বারবার শুধু বেশুমার টাকা হাতানোর অভিযোগ উঠে এসপি আনোয়ারের বিরুদ্ধে।
আগে দায়িত্ব পালনকারী পুলিশ কর্মকর্তারা কি ধোয়া তুলসী পাতা ছিলেন? মোটেও না। অথচ সারা বছর মোটা অংকের মাসোহারা প্রদানকারী পাথর ব্যবসায়ী, বালি ব্যবসায়ী, ড্রেজার সিন্ডিকেট, চোরাকারবারিরাও তাদেরকে সাদা মনের পুলিশ অফিসার, মানবিক এসপি, শান্তির প্রতীক ইত্যাদি বিশেষণে পুরস্কৃত করে বিদায় সংবর্ধনা দিয়েছে। সেই সমঝোতায় অপরাধ বাণিজ্য চালানো চক্রগুলোও বর্তমান এসপির গোপন শত্রু হয়ে উঠেছে। তাদের দেওয়া তথ্যেই এসপি আনোয়ার হোসেনের অজানা রূপটি বেরিয়ে আসে।
যাদুকাটা নদীকে পৈতৃক সম্পত্তির মতো ব্যবহারকারী নেতা ইজারাবিহীন পাথর-বালু উত্তোলনেরও মূল হোতা। তার ভাষায়, সীমান্ত, নদী, পাহাড বেষ্টিত সুনামগঞ্জে কিছু কিছু বাণিজ্যের অলিখিত স্বীকৃতি রয়েছে। সেসব ব্যবসার বিপরীতে পুলিশের জন্যও নিয়মিত খরচ পাঠানোর নিয়ম গড়ে উঠেছে। কিন্তু বর্তমান এসপি এসেই প্রচলিত পরিমাণের চেয়ে দুই-তিন গুণ বেশি মাসোহারা দিতে বাধ্য করছে।
সকল খাতের ব্যবসায়ীরাই মাত্রাতিরিক্ত এ জুলুমবাজিতে অতিষ্ঠ। লাখ লাখ টাকা মাসোহারা দিয়েও চামারের মতো দুর্ব্যবহার হজম করতে হচ্ছে ব্যবসায়ীদের। মোটা অংকের বখড়া আদায়ের মাধ্যমে বেপরোয়া নদী খনন, পাথর ও বালু উত্তোলনের অবাধ সুযোগ দিচ্ছেন এসপি আনোয়ার- এমন অভিযোগ তোলেন খোদ বৈষম্য বিরোধী ছাত্র নেতারা। এ নিয়ে উত্তপ্ত পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে এসপি পিছু হটেন, কিন্তু অপকর্মটি বন্ধ করেননি মোটেও।
দুই-তিন গুণ মাসোহারা নেয়ার ব্যাপারে আমার কাছে সুনির্দিষ্ট প্রমাণ না থাকলেও এসপির বাজে ব্যবহারের বিষয়টি শতভাগ নিশ্চিত। তার নোংরা আচরণের অডিও ভিডিও আমার কাছেও রক্ষিত আছে। নদী ঘিরে বখড়াবাজির পাশাপাশি সীমান্ত অপরাধেও ভিন্নমাত্রার সংযোজন ঘটিয়েছেন এসপি আনোয়ার হোসেন। চোরাকারবারীদের দৈনন্দিন বখড়া আদায়ে তিনি সীমান্তের পয়েন্টে পয়েন্টে অভিনব ঘাটম্যান নিয়োগ শুরু করেন। এ নিয়েও চরম বিতর্কের মুখে পড়েন এসপি।
স্থানীয় পর্যায়ের যে কোনো ঘটনায় মামলা হলেই পাল্টা মামলা এবং সেসব মামলায় প্রবাসী পরিবারের কোনো না কোনো সদস্যকে আসামী করার ব্যাপারে তিনি বেজায় উৎসাহী। অন্তহীন অভিযোগে অভিযুক্ত, চরম বিতর্কিত এসপি আনোয়ার হোসেনকে তবু কেন সুনামগঞ্জেই রাখতে হবে? তাকে কেন্দ্র করে গোটা পুলিশ বাহিনী প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে, নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে জনমনেও।
বিশেষ গপ্পো: চার প্যাকেট ভারতীয় বিড়িসহ একজন চোরা কারবারি আটকের ঘটনায় পুরোনো গপ্পো মনে পড়ে গেল। ২৫/২৬ বছর আগে ঢাকার সিএমএম আদালতে গাঁজা সংক্রান্ত একটি মামলার শুনানি চলছিল। ম্যাজিস্ট্রেট ননী গোপাল চন্দের আদালতে আসামি পক্ষের এডভোকেট মিত্র অভিনব এক আবেদন জানান। ৬০ টাকা মূল্যের মাত্র দুই পুড়িয়া গাঁজাসহ আটক আসামিকে আদালতে পাঠানোর অভিযোগে সংশ্লিষ্ট সাব ইন্সপেক্টর বিরুদ্ধেই উল্টো ব্যবস্থা নিতে আদালতের অনুগ্রহ চাওয়া হয়।
এডভোকেট বলেন, ৬০ টাকার এ গাঁজার মামলার কার্যক্রমে আদালত সংশ্লিষ্টদের সময় অপচয় ছাড়াও সরকারের কমবেশি দেড় লক্ষাধিক টাকা খরচ হবে। পুলিশ কর্মকর্তা নিজের আক্রোশ মেটাতে তুচ্ছ সামাজিক অপরাধকে আইন আদালতে বৃহৎ অপরাধ কথামোভুক্ত করেছেন। তিনি মামলার নামে পরিকল্পিত ভাবে সরকারি বিপুল অর্থ অপচয় ঘটানোর চক্রান্ত এঁটেছেন … অভিনব অভিযোগ শুনে ম্যাজিস্ট্রেট নিজেও অবাক- মুখে শুধু বললেন, বিষয়টি অবশ্যই ভেবে দেখার মতো। সেই ভাবনায় চার প্যাকেট বিড়িও যুক্ত হয় কি না- আমি ভাবছি সেই কথা।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক