মোঃ সুমন হোসেনঃ একসময়ের শান্তির ময়মনসিংহ শহর অনেকটা অশান্তির শহরে পরিণত হয়ে উঠেছিল। নায়ক ছিল একজনেই। তিনি হলেন সিআইপি আমিনুল হক শামীম। তার নির্দেশেই চলতো জেলা প্রশাসন। সামান্য ঘটনায় যে কাউকে হামলা করা ময়মনসিংহ নগরীতে সাধারণ ব্যাপার ছিল। রাজনীতির প্রতিহিংসায় খুনের ঘটনা ঘটতো শহরে। এমনকি হাসি-ঠাট্টা করেও খুন করা হতো। আসামি করা হয় প্রতিপক্ষ নেতাকর্মীদের। নানা ঘটনায় অতিক্রম করেছে-২০১৮ সন। এ বছরই বহু কাঙ্ক্ষিত ময়মনসিংহ সিটি কর্পোরেশনের ঘোষণার বাস্তবায়ন হয়। এটা ছিল নগরবাসীর প্রাণের দাবি। ২০১৮ সাল জুড়েই আলোচনায় ছিল ময়মনসিংহের ছাত্রলীগ নেতা শাওন ও যুবলীগ নেতা আজাদ শেখ হত্যাকাণ্ড। আর এসব খুনের শিকার শুধু সাধারণ মানুষই নয়; রাজনৈতিক ব্যক্তি, জনপ্রতিনিধি খুনের শিকার হয়েছেন। ২০১৬ সালের জানুয়ারী থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ৮ বছরে ময়মনসিংহ শহরের বিভিন্ন স্থানে ১৮৬টি খুন হয় এবং বিভিন্ন সময় ৭৬৮ জনের উপর হামলা করা হয়। আর এসব খুন, হামলা বেশি ভাগই আধিপত্য বিস্তার ও রাজনীতি প্রতিহিংসাকে কেন্দ্র করে। বিশেষ করে ২০১৮ সালের শুরুর দিকে হঠাৎ ময়মনসিংহ শহর ও জেলাজুড়ে অপরাধের মাত্রা বেড়ে যায়। চার দিনের ব্যবধানে তিনটি হত্যাকাণ্ড হয়।
ময়মনসিংহ জেলা জাতীয় পার্টির সহ-সভাপতি মনির চৌধুরী সাংবাদিকদের জানান, ২০১৮ সালে ৩২টি আলোচিত হত্যাকাণ্ড হয় এবং বিভিন্ন সময়ে ৭৬৮ জনের উপর অতর্কিত হামলার ঘটনার সাথে জড়িত ময়মনসিংহ জেলা আ’লীগের সাধারন সম্পাদক এডভোকেট মোয়াজ্জেম হোসেন বাবুল ও ময়মনসিংহ জেলা আ’লীগের সহ-সভাপতি সিআইপি আমিনুল হক শামীম। তাদের দু’জনের দখলে ছিল গোটা ময়মনসিংহ এবং আমিনুল হক শামীম ময়মনসিংহ নগরীর সব অপকর্মের হোতা। তিনি আরও বলেন, আমিনুল হক শামীম ময়মনসিংহ চেম্বার অব কমার্স কে নিজের দখলে রেখে তার অনুসারীদের দিয়ে চালাতেন। ময়মনসিংহ জেলার অনেক বড় বড় ব্যবসায়ী আছেন যারা শামীমের অনুসারী না তাদেরকে সে চেম্বারের মেম্বার হতে দিতেন না। জাতীয় পার্টি ক্ষমতায় থাকাকালে তখনও সে জাতীয় পার্টির নেতা লেবাস ধরে ময়মনসিংহ বিভাগসহ সারাদেশে পরিবহন সেক্টরে চাঁদাবাজি করে হাজার হাজার কোটি টাকা কামিয়েছেন। মনির চৌধুরী বলেন, আমি ইতিমধ্যে ময়মনসিংহ সিটি কর্পোরেশনের কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলেছি। তারা আমাকে জানিয়েছেন,ময়মনসিংহ সিটি কর্পোরেশনের বরাদ্দের প্রায় ১৫’শ কোটি টাকা পাচার করেছেন সাবেক মেয়র ইকরামুল হক টিটু। আমি সকল তথ্য সংগ্রহ করে দুদক চেয়ারম্যান বরাবরে একটি আবেদন জমা দিয়েছি। যা এখন তদন্ত চলছে। দুর্নীতি দমন কমিশন দুদকের উপ-পরিচালক আলী আকবর জানান, ময়মনসিংহের মনির চৌধুরী নামের এক ব্যাক্তি একটি আবেদন করেছেন। অনুমোদনের জন্য প্রধান কার্যালয়ে পাঠিয়েছি। অনুমোদন হয়ে আসলে অনুসন্ধান শুরু করবো।
ময়মনসিংহে কর্মরত সাবেক এক পুলিশ পরিদর্শক জানান, নগরীতে ১৮৬ টি খুনের মধ্যে ৩২টি আলোচিত খুনের সাথে কোন না কোন ভাবে জড়িত আ’লীগের প্রভাবশালী ১২ নেতা। তিনি বলেন, আমি একটি আলোচিত খুনের মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ছিলাম। আমার ওপর প্রচুর মানসিক চাপ প্রয়োগ করেন আমিনুল হক শামীম সাহেব ও এডভোকেট মোয়াজ্জেম হোসেন বাবুল। তারা সাবেক ডিআইজি নিবাস চন্দ্র মাঝি স্যারের কাছে আমার নামে বিচার দেন। তারপর আমাকে ডেকে নিয়ে অশালিন ভাষায় গালাগালি করেন। এরপর চট্রগ্রামে বদলি করে দেন। ময়মনসিংহ কোতোয়ালী মডেল থানার ওসি শফিকুল ইসলাম জানান,ময়মনসিংহ নগরীতে ৮ বছরে ১৮৬টি হত্যাকাণ্ড হয়েছে এর মধ্যে ৩২টি আলোচিত হত্যাকাণ্ডের সাথে কারা জড়িত তাদের সর্ম্পকে খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। কেউ অভিযোগ করলে তদন্তপূর্বক আইনগত ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে। জানা যায়, ২০১৮ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি দিনগত মধ্যরাতে নগরীর মৃত্যুঞ্জয় স্কুল রোড এলাকায় রহস্যজনকভাবে গুলিবিদ্ধ হন ছাত্রলীগ নেতা শাওন। পরে তাকে উদ্ধার করে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি করা হয়। অবস্থার অবনতি হলে তাকে রাজধানীর ইবনেসিনা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২০১৮ সালের ০৮ মার্চ দুপুরে মারা যান শাওন। সূত্র মতে, এ ঘটনার প্রথম দিকে শাওন নিজের গুলিতেই গুলিবিদ্ধ হয়েছেন এমন খবর ছড়িয়ে দেন তার পিতার পছন্দের ব্যাক্তিরাই। পরবর্তীতে রহস্যজট খুলতে থাকে। এরহস্য আজও ঘুরপাক খাচ্ছে। গভীর রাতে সিসি ক্যামেরা ফুটেজ উধাও হয়ে যায়। অপরাধ দমন ও নিয়ন্ত্রণে ময়মনসিংহ-ঢাকা মহাসড়কের ৬৫ কিলোমিটার এলাকা সিসি ক্যামেরা নেটওয়ার্কের আওতায় আনা হলেও ময়মনসিংহ মহানগরীর গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে সিসি ক্যামেরা স্থাপন করা হয়নি। এজন্য বাতির নিচে অন্ধকার।
মো. সাজ্জাদ আলম ওরফে শেখ আজাদ। পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে একসময় রাজনৈতিক সভা সমাবেশে যাওয়া শুরু করেন। এরপর ১৮ বছরের ব্যবধানে হয়ে ওঠেন ময়মনসিংহ শহরের রাজনীতির একজন ‘গুরুত্বপূর্ণ’ ব্যক্তি। ২০১৮ সালের গত ২ এপ্রিল তিনি কয়েক হাজার কর্মী নিয়ে শহরে মিছিল বের করে সাড়া ফেলে দেন। সাদা পাঞ্জাবি পরে তিনি ছিলেন মিছিলের সামনে। পেছনে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নামের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর নামেও স্লোগান দিচ্ছিলেন কর্মীরা। সেদিন বিশাল কর্মী বাহিনী নিয়ে মিছিল করার প্রায় চার মাস পর ৩১ জুলাই দিনদুপুরে খুন হন শেখ আজাদ। প্রথমে তাঁর হাত ও পায়ে গুলি, তারপর গলা কেটে হত্যা করা হয়। ধারালো অস্ত্র দিয়ে চিরে ফেলা হয় বুকের তিনটি স্থান। আজাদ ছিলেন যুবলীগের ময়মনসিংহ মহানগর শাখার আহ্বায়ক কমিটির একজন সদস্য। বয়স হয়েছিল ৩২। অষ্টম শ্রেণি শেষে পড়াশোনার পাট চুকিয়ে দেন। এরপর ধীরে ধীরে রাজনীতিতে সক্রিয় হন। আজাদের পরিবার বলছে, নিজের ‘সাম্রাজ্যের’ জন্য হুমকি মনে করে খুনিরা।
সিআইপি আমিনুল হক শামীমের কাছে বক্তব্য জানতে তার মোবাইল নাম্বারে একাধিকবার ফোন করেও পাওয়া যায়নি। হোয়াটসঅ্যাপে বার্তা পাঠানো হলেও ২৪ ঘন্টাও কোন উত্তর মেলেনি। এ ঘটনা সম্পর্কে জানতে আমিনুল হক শামীমের রাজনৈতিক সহকর্মী নাম প্রকাশের অনুচ্ছেক একজন জানান, শামীম ভাই একজন ব্যবসায়ী মানুষ। ময়মনসিংহ বাসীর কল্যাণের জন্যই তিনি কাজ করেছেন। রাজনীতি কিছু নেতা তাকে ফাঁসানোর চেষ্টা করছেন। তিনি কোথায় আছেন জানতে চাইলে, আমি জানিনা। ইতিমধ্যে আমার সাথে যোগাযোগ কম হচ্ছে।
ময়মনসিংহ কোতোয়ালি মডেল থানার ওসি শফিকুল ইসলাম জানান, ময়মনসিংহ নগরীতে গত ৮ বছরে ১৮৬টি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। এরমধ্যে ৩২ টি আলোচিত হত্যা হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় অনেকে ন্যায় বিচার পাইনি। কোন ভুক্তভোগী যদি থানায় অভিযোগ করে তদন্ত করে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এছাড়াও ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি আমিনুল হক শামীম আলোচিত ৩২টি হত্যাকাণ্ডের সাথে কোন না কোন ভাবে তিনি ও তার সন্ত্রাসী বাহিনী জড়িত। বেশ কয়টি হত্যাকান্ডের ঘটনায় আমরা প্রাথমিক তদন্তে আমিনুল হক শামীম জড়িত বলে সত্যতা পেয়েছি। তাকে গ্রেফতারের অভিযান চলছে।