সাঈদুর রহমান রিমনঃ দেশের মিডিয়া সেক্টরে দালালি, প্রতিরোধ, পাল্টা দালালি আর পা চাটা গোলামদের নিয়ে কাদা ছোড়াছুড়ি চলছে। সেই ফাঁকে শিক্ষার্থীরা এবার সাংবাদিকতাকেও সংস্কার করতে চায়! তারা চোখ রাঙানি, হুমকি ধমকি দিয়ে সাংবাদিকদের চাপে রাখতে চান- নিয়ন্ত্রণ করতে চান গণমাধ্যমকে। যারাই ক্ষমতার কাছাকাছি থাকে বা ভাবে তাদেরই গণমাধ্যমকে আজ্ঞাবহ রাখতে বিকৃত শখ জাগে। এটা আগেও ছিল।
বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা কেউ কেউ রীতিমত অফিসিয়াল কায়দায় চিঠি পাঠিয়ে প্রেসক্লাব পুনর্গঠন, নেতৃত্বের রদবদল, আলোচনার জন্য সাংবাদিকদের ডেকে পাঠাচ্ছেন। জাতীয় প্রেসক্লাবের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষকেও চিঠি পাঠিয়ে দালাল সাংবাদিক’দের একটা তালিকা পাঠিয়েছে এবং তাদেরকে গণমাধ্যম জগতে নিষিদ্ধ করারও আহ্বান জানিয়েছে।
এইতো সেদিন, ২৪ জুলাই থেকে শিক্ষার্থীদের বিরামহীন আন্দোলন কালে আমরা অকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়েছি প্রকাশ্যে। একের পর এক লেখা দিয়ে উদ্বুদ্ধ করেছি। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ‘আমাদের সন্তান’ আখ্যা দিয়ে তাদের নির্বিচার হত্যার করুণ বিবরণ তুলে ধরেছি। আরটিভি অনলাইনসহ অর্ধ শতাধিক পত্রিকা ও অনলাইনে সেসব লেখা প্রকাশ হয়েছে অবলীলায়। নিজের লেখা নিজে পাঠ করতে গিয়েও অশ্রু সংবরণ করতে পারিনি, আবেগাপ্লুত হয়েছেন পাঠকরাও।
বিজয় কেড়ে আনা আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের প্রতি এখনও সেই ভালোবাসা অক্ষুন্ন রয়েছে, আছে অভিন্ন আবেগের টানও। কিন্তু আমাদের সন্তানেরা ঐতিহ্যবাহী সাংবাদিকতায় হস্তক্ষেপ করবে, সাংবাদিকদের নিয়ন্ত্রণে উদ্যোগ নিবে এটা কেন যেন খাপছাড়া মনে হচ্ছে। কেন যেন তা কল্পনাতীত লাগছে। মেধাবী দাবিদার ছাত্রদের পাল্টা কিছু বলার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই। শুধু বলবো- যাদের কাজ তাদেরই করতে দিন, গণমাধ্যম ক্ষেত্রে কোনো হস্তক্ষেপ কাম্য নয়। নিরীহ সাংবাদিকদের অভিশাপ বেশ কঠিন, বড়ই নির্মম। পেশাজীবি কয়েকজন অন্ধ দালালের কারণে গোটা গণমাধ্যম সেক্টরটি আজ প্রশ্নবিদ্ধ, আস্থা ও বিশ্বাসযোগ্যতা আজ তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে।
তারপরও মনে রাখতে হবে দলীয় লেজুড়বৃত্তি মুক্ত সৎ সাংবাদিকদের সংখ্যা অনেক বেশি। তারা বছরের পর বছর ধরে রাষ্ট্রযন্ত্রের ধারাবাহিক অত্যাচার, নিপীড়ন, হয়রানির শিকার, অবজ্ঞা অবহেলা তাদের নিত্যসঙ্গী। তাদের আপোসহীন মনোভাব, সততা, নিরপেক্ষতা সকল প্রশ্নের ঊর্ধ্বে। এই শ্রেণীর বাড়ি, গাড়ি, অর্থবিত্ত বলতে হয়তো উল্লেখ করার মতো কিছুই নেই, তবে ব্যক্তিত্ব আর পেশাদারিত্বের ইগো আছে চূড়ান্ত পর্যায়ের। পেশাদারিত্বের জায়গা থেকে দলবাজ মুক্ত প্রকৃত সাংবাদিকরা কখনও গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ ও সাংবাদিকতায় কারো হস্তক্ষেপ চায় না।
দালালরা বরাবরই সরকার ও ক্ষমতাসীন দলের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় অতিউৎসাহী ছিল, তারা তা কার্যকরও করেছে রন্ধ্রে রন্ধ্রে। একটানা ১৬টি বছর যন্ত্রনাদগ্ধতার পর সম্ভাবনার একটা পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে, ও অসান ঘটেছে একচ্ছত্র দাপটের। এখন দালাল মুক্ত শ্রদ্ধাভাজনরা সাংবাদিকতার হারানো ঐতিহ্য ফেরাতে প্রাণপণ লড়াই করবেন, পেশাদারিত্বের দৃষ্টিকোণ থেকে মজবুত ভিত্তিও গড়ে তুলবেন। এক্ষেত্রে আমরা যদি আবার কোনো সরকার বা সরকার সমর্থিত কোনো গোষ্ঠীর আজ্ঞাবহ হয়ে উঠি, তাদেরই নিয়ন্ত্রণে সাংবাদিকতার নানা কাঠামো সংস্কার করতে চাই তাহলে কি দাঁড়ায়? এক গোষ্ঠীর দালাল হটিয়ে আমরা নিজেরাই আরেক গোষ্ঠীর দালাল হয়ে উঠছি না তো?
আমাদের পেশায় কি সার্বজনীন শ্রদ্ধার কোনো ব্যক্তিত্ব নাই? এমন কোনো অভিভাবক কি নাই যার আহ্বানে মতভিন্নতা তুচ্ছ করে সবাই এক কাতারে দাঁড়াবে? তাহলে অন্যের সাহায্যে আধিপত্য প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ থেকে আমাদের ফিরে আসাই ভালো। ক্ষমতার পালা বদলের সঙ্গে সঙ্গে জাতীয় প্রেসক্লাব থেকে শুরু করে উপজেলা পর্যায়ের প্রেসক্লাবও দখল বেদখলের প্রতিযোগিতা শুরু হতে দেখলাম। এসব প্রেসক্লাবের সাবেক ব্যবস্থাপনার সবাইকে গড় হিসেবে দালাল আখ্যা দিয়ে বিতাড়িত করা হয় কিংবা তারা স্বেচ্ছায় সরে দাঁড়ান। নতুন দখলে আসা সাংবাদিক বন্ধুরা আগের সবাইকে হটিয়ে শুধু নিজেদের সমমনাদের নিয়ে নতুন ব্যবস্থাপনা কমিটি বানিয়েছেন। ফলে বেশ সংখ্যক সাংবাদিক কিন্তু প্রেসক্লাবের বাইরেই থেকে গেলেন। তাহলে তারা কি আরেকটি পালাবদলের অপেক্ষায় থাকবেন? তার মানে দ্বন্দ্ব বিরোধ থেকেই গেল।
আমি স্পষ্ট ভাবে বলতে চাই, যদি দালাল হিসেবেই কিছু সাংবাদিক চিহ্নিত হয়ে থাকে তাদেরকে স্ব স্ব প্রতিষ্ঠান থেকেও হটিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। কারণ, দালালদের সাংবাদিকতায় থাকতে দেয়াটাই তো উচিত নয়। দালালি সাংবাদিকতার যুগেও ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির নেতৃত্ব, কর্মকান্ড ও সার্বিক পথচলা অনুকরণীয় উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। সেখানে কোনো গ্রুপিংয়ের ঠাঁই নেই। মূলত নির্বাচন কালে প্যানেলভুক্ত হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকেই গ্রুপিং, দ্বন্দ্ব, সংঘাতময় সম্পর্কের সূত্রপাত ঘটে। সর্বাগ্রে প্যানেল বাজীর নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতা বন্ধ করা উচিত। দলবাজির তো প্রশ্নই উঠে না।
১) সাংবাদিক ইউনিয়নের বিভক্তি বিলুপ্ত করে প্রকৃত সাংবাদিকদের (যারা নিয়মিত গণমাধ্যমে কাজ করেন) তাদের সদস্য বানানো। বিএফইউজে, ডিইউজের উভয় অংশ ভেঙে দিয়ে একীভূত করে পূণরায় নির্বাচনের মাধ্যমে নেতৃত্ব গড়ে তোলা। ১. ক) সাংবাদিক ইউনিয়নকে শুধু তাদের সদস্যদের জন্য নয়, দেশের সকল সাংবাদিকদের জন্য দায়িত্ববান হওয়া। প্রতি দুই মাস অন্তর অন্তর দেশের সাংবাদিকতা ও সাংবাদিকদের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে প্রতিবেদন প্রস্তুত করে তা আনুষ্ঠানিক ভাবে সরকারি সকল বিভাগে সুপারিশসহ প্রেরণ করা। ১. খ ) একইভাবে জাতীয় প্রেসক্লাবকে কেবলমাত্র পেশাদার সাংবাদিকদের অংশগ্রহণে ঢেলে সাজানোসহ দেশের সকল প্রেসক্লাবের প্রতিনিধির সম্পৃক্ততা গড়ে তোলা। জাতীয় প্রেসক্লাব প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে জেলা পর্যায়ে সাংবাদিকদের দ্বন্দ্ব-সংঘাত মিটিয়ে অভিন্ন প্রেসক্লাব গঠনের ব্যবস্থা করা।
২) সাম্প্রতিক আন্দোলনে যে সকল সংবাদকর্মী হতাহত হয়েছেন তাদের তালিকা প্রকাশ ও যথাযথ ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করা।
৩) বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল, পিআইবি ও তথ্য কমিশন পুনর্গঠন করে সেখানে সাংবাদিক সমাজের প্রতিনিধি বাড়ানো। প্রেস কাউন্সিলকে কার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার পাশাপাশি গণমাধ্যম ও সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগসমূহের যথাযথ প্রতিকারের ব্যবস্থা গ্রহণ করা। ৪) সাংবাদিক হত্যা মামলাগুলো দ্রুততার সঙ্গে স্বচ্ছ বিচার নিশ্চিত করা। ৫) সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্টকে ঢেলে সাজানো সহ হামলায় আহত, মামলা ধকলে পড়া ও হুমকির শিকার সাংবাদিকদের পাশে দাঁড়ানো। ৬) সাইবার নিরাপত্তা আইনসহ স্বাধীন সাংবাদিকতা পরিপন্থী সকল কালাকানুন জরুরিভাবে বাতিলের উদ্যোগ নেওয়া।
৭) ডিএফপি, সম্পাদক পরিষদ, সাংবাদিক ইউনিয়ন প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে সরেজমিন পরিদর্শন ও পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে সংবাদপত্রের প্রকৃত প্রচার সংখ্যা নিরুপণ, ওয়েজবোর্ড বাস্তবায়ন নিশ্চিতকরণ, পেশাদারিত্ব বজায় রাখার বাধ্যতামূলক উদ্যোগ নেওয়া।
(লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক)