সাঈদুর রহমান রিমনঃ জাফলং ট্যুরিস্ট পুলিশের কার্যক্রম আমাকে প্রতিদিনই মুগ্ধ করছে। সত্যি কি অসাধারণ তাদের ব্যবহার, কি চমৎকার সম্বোধন। বাবা, মা, ভাই, বোন সম্বোধনে সবাইকে আপন করে নিয়ে সাবলীল ভাবে চাপিয়ে দেয়া হয় নানা নির্দেশনা। সে নির্দেশনা হলো সব ধরনের বিপজ্জনক অবস্থা এড়িয়ে চলার, সে নির্দেশনা নিজেরা ভালো থাকার। সকলেই জানেন, জাফলং এর পাথর, পাহাড়, ঝর্না নদীর মায়াবী এ পর্যটন এলাকাটি ভারত বাংলাদেশ সীমান্তের এক্সট্রিম জিরো পয়েন্টে। অজানা, অসতর্কতায় প্রায়ই পর্যটকরা জিরো পয়েন্ট অতিক্রম করে ভারতের ভিতরে ঢুকে পড়েন।
ওই সময় বিএসএফ টহলরত থাকলে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার সূত্রপাত ঘটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। এমন বিব্রতকর ঘটনা এড়াতে জাফলং ট্যুরিস্ট পুলিশের বিরামহীন তৎপরতা যেন চলতেই থাকে।কখনও উচু পাথরের উপর দাঁড়িয়ে, কখনও পিয়াইনের স্রোত পানিতে কোমর পর্যন্ত ভিজে ট্যুরিস্ট পুলিশ সদস্যরা দুই হাত প্রসারিত করে আবেদন জানাতে থাকে। বলতে থাকে, প্লীজ বাবা মায়েরা আর একটুও উজানের দিকে আসবেন না, আপনারা অলরেডি জিরো পয়েন্ট ব্রেক করে ফেলতেছেন, প্লীজ পিছিয়ে যান, প্লীজ পিছিয়ে যান। আবার কখনও হ্যান্ড মাইকে ভাসতে থাকে পুলিশ কণ্ঠের ঘোষণা। পাহাড়ি ঢলের তীব্র স্রোত শুরু হয়েছে জাফলংয়ে। এ স্রোত বিপজ্জনক, পানি খুব ঘোলা।
পর্যটকরা কেউ এখন স্রোত পেরিয়ে এপার ওপার যাতায়াতের ঝুঁকি নিবেন না।প্লীজ আপনারা নৌকায় উঠে খাসিয়া পল্লীর ঘাটে যান, সেখানে মায়াবী ঝর্না ঘুরে আসুন, ভালো লাগবে। আদুরে কন্ঠে দারুণ মমত্বের সঙ্গে দেয়া পুলিশের ঘোষণাগুলো যেন অতি আপনজনের ভালোবাসার মিনতি।তাদের অনুরোধ বারণ উপেক্ষা করার বিবেকী কোনো উপায় থাকে না।আমি জানি না ট্যুরিস্ট পুলিশের জাফলং সাব জোনের দায়িত্বে কোন অফিসার রয়েছেন, জানি না সেখানকার তত্ত্বাবধায়ক কর্মকর্তার নামধামও।
জানার প্রয়োজনবোধও করছি না। শুধু বুঝতে পেরেছি, ট্যুরিস্ট পুলিশের পোশাক পরিধানকারী ব্যক্তিরা আমার সন্তানের অভিভাবক, আমার অসহায় বোনের কঠিন নিরাপত্তা বেষ্টনী হওয়া ভাই, আমার বয়স্ক স্বজনের জন্য দায়িত্ববান সন্তান। আমার এসাইনমেন্ট নিয়ে ঘুরে আসা রিপোর্টারের ভিডিওচিত্র যতো দেখেছি ততোই আমি মুগ্ধ হয়েছি, ততোই জাফলং ট্যুরিস্ট পুলিশের প্রেমে পড়েছি। এখন কাছ থেকে শুধু জাফলং ট্যুরিস্ট পুলিশকে দেখার ইচ্ছে জেগেছে আমার।প্রতিটি দৃশ্যপট দেখে ট্যুরিস্ট পুলিশের কোনো সীমাবদ্ধতা আছে বলে আমার মনেই হয়নি। বরং তাদের দায়িত্বের ধরন দেখে মনে হয়েছে, প্রতিটি স্পটে শত শত পর্যটককে তারা যেন হাতে হাত ধরে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখাচ্ছেন।
ট্যুরিস্ট পুলিশের কর্মকর্তা গোছের একজন মাঝেমধ্যেই নিজে হ্যান্ড মাইক হাতে যেসব অনুরোধ নির্দেশনা ঘোষণা দেন সেসব আবার ভিডিও আকারে জাফলং ট্যুরিস্ট পুলিশ ফেসবুক পেইজেও আপলোড দেয়। আমি লক্ষ্য করি, নির্দেশনা যাই দেয়া হোক তার ভিডিওতে এমন সব লোভনীয় দৃশ্য দেখানো হয় যে, তা দেখেই জাফলং যাওয়ার আগ্রহ জাগবে যে কারোর। শুধু পুলিশি আইন শৃংখলা রক্ষাই নয়, পর্যটকদের আকৃষ্ট করার রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডেও তারা চমৎকার ভাবে অবদান রেখে চলছে।
আরো একটা দৃশ্য আমি কোনো ভাবেই ভুলতে পারছি না।
এক মা তার স্বজনদের নিয়ে মায়াবী ঝর্ণায় একের পর এক ছবি তোলায় ব্যস্ত, আছে উচ্ছাস আনন্দে মশগুল,,, অথচ তার শিশু ছেলেটি সময় কাটাচ্ছে এক ট্যুরিস্ট পুলিশের কোলে। আমার রিপোর্টার ওই পুলিশ সদস্যকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, দীর্ঘ সময় ধরে আরেকজনের বাচ্চা কোলে রাখার ডিউটিতে কি বিরক্ত হচ্ছেন না? হাসিমুখে জবাব ছিল তার – ‘প্রশ্নই উঠে না। এখানেই দাঁড়িয়ে সবাইকে দেখাশোনার দায়িত্ব আমার।
একাই ছিলাম, বাচ্চাটা কোলে থাকায় তার সঙ্গে হাসি গল্পে ভালোই সময় কাটাতে পারছি।’ এমন মানসিকতা গড়ে তোলা জাফলং ট্যুরিস্ট পুলিশ সদস্যরা “করোনাকালীন মানবিক পুলিশের” কথা মনে করিয়ে দেয়। জাফলং ঘুরতে যাওয়া আরেক বয়স্ক পর্যটকের বক্তব্য হচ্ছে, ‘অস্ত্রশস্ত্র, লাঠিসোটা ছাড়া ট্যুরিস্ট পুলিশ শুধু ভালোবাসা, মমতা দিয়ে শৃংখলা রক্ষা করে-এটাই আমার কাছে আজব লেগেছে।'(লেখক : সম্পাদক, দৈনিক দেশবাংলা)