• রবিবার, ১২ জানুয়ারী ২০২৫, ০২:০১ পূর্বাহ্ন

সৈয়দপুরে রেলের জলাশয় দখল ও ভরাট করছে ৩ নেতা, এলাকাবাসী উদ্বিগ্ন, এস্টেট বিভাগ নির্বিকার

সংবাদদাতা / ১২১ পাঠক ভিউ
আপডেট সময় : বুধবার, ২১ জুন, ২০২৩

মোঃ মাইনুল হক, বিশেষ প্রতিনিধিঃ  রেলওয়ের শহর হিসেবে পরিচিত নীলফামারীর সৈয়দপুরে আবাসিক এলাকার পরিত্যক্ত পানির আধার একটি ডোবা দখলের পর ভরাট করছে তিন রাজনৈতিক নেতা। ভরাটের পর সেখানে নির্মাণ করা হবে বহুতল ভবন। এই জলাশয়টি বন্ধ হয়ে গেলে রেলওয়ের কোয়াটার, বাংলো, অফিস, ক্লাবসহ অন্যান্য বাসা-বাড়ি, শিক্ষা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের অপসারিত পানি নিষ্কাসনের আর কোন জায়গা থাকবেনা। ফলে অচল হয়ে পড়বে পুরো এলাকার ড্রেনেজ ব্যবস্থা। এতে ড্রেন উপচে নোংরা ময়লা পানি রাস্তাসহ বাসা-বাড়ির আঙ্গিনায় গড়াবে। সৃষ্টি হবে জলাবদ্ধতা। সেই আতঙ্কে উদ্বিগ্ন এলাকাবাসী। ভোগান্তির কথা চিন্তা করে প্রতিবাদ জানালেও থামেনি দখলকারীরা।
এমনকি স্থানীয় এইএন কর্তৃক নিষেধ করে লাল পতাকাযুক্ত খুটি দিয়ে চিহ্নিত করে দিলেও তা উপরে ফেলে পুরোদমে করছে মাটি ভরাটের কাজ। রেলওয়ের এস্টেট বিভাগের পার্বতীপুর ফিল্ড কানুনগো অফিস কর্তৃপক্ষ নির্বিকার থাকায় জনমনে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে এবং সরকারের প্রতি নেতিবাচক ধারণা দানা বাধছে।
জানা যায়, শহরের হাতিখানা মহল্লায় লায়ন্স স্কুল এন্ড কলেজের দক্ষিণ পশ্চিমে সৈয়দপুর রেলওয়ে জেলার সহকারী পুলিশ সুপারের সরকারী বাসভবনের পিছনে একটি বিশালাকৃতির ডোবা রয়েছে। বৃটিশ আমলে শহরের গোড়াপত্তনের সময়ে এটি তৈরী করা হয়েছে। সেই সময় থেকেই এটি বিদ্যমান।
শহরের সবচেয়ে অভিজাত এলাকা রেলওয়ে অফিসার্স কলোনী। এখানে অবস্থিত সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানার বিভাগীয় তত্বাবধায়ক (ডিএসডাব্লিউ), কর্ম ব্যবস্থাপক (ডাব্লিউএম), রেলওয়ে পুলিশ সুপার সহ সব উর্ধ্বতন কর্মকর্তার ও প্রশাসনিক ব্যক্তিদের বাংলো ও ডাবল কোয়াটার এবং রেলওয়ে অফিসার্স ক্লাব, একাউন্ট অফিস, এইএন অফিস অবস্থিত। এছাড়াও রয়েছে লায়ন্স স্কুল এন্ড কলেজ, জিনপীর মসজিদসহ আশেপাশের অসংখ্য বসতবাড়ি। এসবের ব্যবহৃত বর্জ্য পানি অপসারনের একমাস স্থান এই ডোবাটি। সেটি দখল করে মাটি ও বালু ফেলে ভরাট করছেন ওই এলাকার পৌর ৯ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও যুবদল নেতা ফরহাদ হোসেন, স্থানীয় যুবলীগ নেতা জুয়েল ও টোকেন। ইতোমধ্যে প্রায় অর্ধেক অংশ মাটি দিয়ে ভরাটের ফলে ডোবার পানি ড্রেনগুলো দিয়ে উল্টো দিকে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হয়ে ড্রেনেজ ব্যবস্থা অনেকাংশে অচল হয়ে পড়েছে।
শুক্রবার অতিরিক্ত পানি অপসারণ হলে ড্রেন উপচে পানি রাস্তায় এসে জমছে। সামান্য বৃষ্টি হলেই স্থায়ী জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে। বাসা-বাড়ির আঙ্গিনাসহ নিচু ঘরেও প্রবেশ করছে ওই নোংরা ময়লা দূষিত পানি। এখনই এমন ভোগান্তি। ডোবাটা সম্পূর্ণ ভরাট হয়ে স্থায়ী স্থাপনা তৈরী হলে পানি নিষ্কাসন একেবারে বন্ধ হয়ে চরম দূরাবস্থায় পড়বে এলাকাবাসী। একারনে প্রতিবাদ জানিয়েও কোন সমাধান পাওয়া যায়নি। বরং উল্টো দখলকরী সরকারী দলের নেতা আর নির্বাচিত জনপ্রতিধির দাপটে কোণঠাসা অবস্থা। রেলওয়ের কর্মকর্তারাও নির্বিকার থাকায় তাদের ভুমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। টাকার বিনিময়ে রেলওয়ের কর্তৃপক্ষ ম্যানেজ হওয়ায় প্রায় ২০ কোটি টাকা মূল্যের সরকারী সম্পত্তি বেহাত হয়ে যাচ্ছে।
বিশাল এই জায়গায় স্থাপনা নির্মাণের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকার মালিক হওয়া ও ব্যবসা করতে আওয়ামীলীগ ও বিএনপি নেতা হাতে হাত মিলিয়ে দখল ও ভরাট কাজ প্রকাশ্যেই চালাচ্ছে। সংবাদকর্মীরা ছবি তুলতে গেলে যুবলীগ নেতা টোকেন বাধা দেয়। প্রতিবাদ করলে সরকারী দলের লোক হিসেবে দাপট দেখায়। প্রশাসনকে কটাক্ষ করে বলে, রেলওয়ে কর্মকর্তা আর পুলিশ আমাদের হুকুমে চলে। সাংবাদিকরাও নিউজ করে আমাদের কিছুই ছিঁড়তে পারবেনা। জায়গাটা তো মাগনা নিচ্ছিনা। অনেক টাকায় কিনে নিতে হয়েছে। রেলওয়ের হলেও এটা আমাদের কেনা সম্পত্তি। এখানে কারও আইন ও মাতব্বরি খাটবেনা। কার কি করার আছে করে দেখাক।
কাউন্সিলর ফরহাদ ও যুবলীগ নেতা জুয়েলের সাক্ষাৎ না মেলায় এবং মোবাইলে বার বার কল দিলেও রিসিভ না করায় তাদের মন্তব্য জানা সম্ভব হয়নি। তবে এলাকাবাসী বেশ ক্ষোভের সাথে এই দখলবাজী এবং অবৈধভাবে ও অবিবেচকের মত ভরাটের প্রতিকার দাবী করেছেন। তারা বলেন মাত্র তিনজন লোকের বেআইনী খায়েসের কারণে এলাকার হাজার হাজার মানুষ চিরস্থায়ী দূর্ভোগের শিকার হতে চলেছে। তাই এব্যাপারে রেলওয়ের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ প্রশাসন, মেয়র, পৌর ও উপজেলা আওয়ামীলীগ সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।
রেলওয়ের উপ-সহকারী প্রকৌশলী (আইওডাব্লিউ) শরিফুল ইসলাম বলেন, খবর পেয়ে লোক পাঠিয়ে নিষেধ করেছি এবং লাল পতাকা লাগিয়েছি। তারপরও ভরাট কাজ চলছে বলে আমার জানা নাই। তবে সবসময় পাহারা দেয়াতো সম্ভব নয়। আমাদের লোকবল অনেক কম। তাছাড়া জলাশয়টি মাছ চাষের জন্য লিজ নেয়া। তার শ্রেণী তথা অবকাঠামোগত পরিবর্তন ঘটালে সেটি দেখার দায়িত্ব রেলওয়ের এস্টেট বিভাগের। নির্বাহী প্রকৌশলী কাজী ওয়ালি-উল হক বলেন, মুলতঃ জলাশয় ও ভূমির দায়িত্ব রেলওয়ে এস্টেট ডিপার্টমেন্টের। আমাদের অধীনে বাংলো, কোয়াটার ও অন্যান্য স্থাপনা। তারপরও আমরা জানতে পেরে ব্যবস্থা নিয়েছি। মামলার উদ্যোগও নেয়া হয়েছে। বাকিটা এস্টেট বিভাগ দেখবে।
তিনি আরও বলেন, লিজ নিয়ে থাকলেও তা যেজন্য নেয়া সেই কাজেই ব্যবহার করতে হবে। কোনভাবেই রেলওয়ের জলাশয় ভরাট করার ইখতিয়ার কারো নেই। শর্ত ভঙ্গ করলে লিজ বাতিল করাসহ বেআইনী কর্মকাণ্ডের জন্য আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। সে যেই হোক। সরকারী দলের লোক বলেও পার পাবেনা। বরং দলের নাম ভাঙ্গিয়ে অবৈধ কাজ করার দায়ে আরও কঠোর শাস্তির আওতায় আনা হবে। রেলওয়ের পার্বতীপুর ফিল্ড কানুনগো জিয়াউল হকের সাথে মুঠোফোনে কথা হলে তিনি বলেন, উল্লেখিত জলাশয়টি কারো নামেই বরাদ্দ নাই। কেউ মাটি ভরাট করলে তা দখল করা হচ্ছে। কারা করছে সে ব্যাপারে এলাকাবাসী কারো নাম বলছেনা।
এখন যেহেতু নাম জানতে পারলাম, মামলা করবো। কিন্তু থানায় অভিযোগ দিলেও গ্রহণ করেনা। তাই আমাদের কিছুই করার থাকেনা। তাহলে এই সম্পত্তি রক্ষা করবে কে? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, দায়িত্ব আমাদেরই, কিন্তু সম্ভব হচ্ছেনা। দখল, ভরাট ও স্থাপনা তৈরী হয়ে গেলেও উপায় নাই। অভিযোগ রয়েছে পূর্বের মতই মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে কানুনগো জিয়াকে ম্যানেজ করেই এই কাজটাও করা হচ্ছে। এভাবে ইতোপূর্বে সৈয়দপুরে রেলওয়ের জায়গায় প্রায় শতাধিক অবৈধ  বহুতল ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। সেইসাথে শত শত বাংলো ও কোয়াটারসহ আশপাশের জমি ও অন্যান্য ফাঁকা জায়গা সম্পূর্ণরূপে অবৈধ দখলে চলে গেছে।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

বিস্তারিত...