ঢাকার আশুলিয়ায় একই পরিবারের তিনজনকে গলা কেটে হত্যার ঘটনায় স্বামী-স্ত্রীকে আটক করেছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। গ্রেপ্তাররা হলেন: হত্যাকাণ্ডের হোতা সাগর আলী (৩১) ও তার স্ত্রী ইশিতা বেগম (২৫)। সোমবার (২ অক্টোবর) রাতে গাজীপুরের শফিপুর এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাদের আটক করা হয়। মঙ্গলবার (৩ অক্টোবর) দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র্যাব মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র্যাব সদর দপ্তরের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইং পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
তিনি বলেন, ৯০ হাজার টাকা চুক্তিতে শারীরিক চিকিৎসার কথা বলে বাসায় গিয়ে ইসবগুলের শরবতের সঙ্গে মোক্তার হোসেনকে চেতনানাশক ওষুধ মিশিয়ে খাওয়ানো হয়। সাগর আলীর আশানরুপ অর্থ না পেয়ে ক্ষোভের বশে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে ও গলা কেটে প্রথমে মোক্তারকে হত্যা করা হয়। পরে অন্য রুমে থাকা ভুক্তভোগীর স্ত্রী ও তাদের সন্তানকে একইভাবে হত্যা করা হয়।
কমান্ডার খন্দকার আল মঈন, নিহত মোক্তার ও তার স্ত্রী সাহিদা আশুলিয়ার একটি পোশাক কারখানায় কাজ করতেন। তার সন্তান মেহেদী হাসান জয় স্থানীয় একটি স্কুলে ৭ম শ্রেণিতে পড়াশোনা করতো। ভুক্তভোগী মোক্তার ও তার স্ত্রী চাকরির উদ্দেশে সন্তানসহ বেশ কিছুদিন আগে ঠাকুরগাঁও থেকে সাভারের আশুলিয়া এলাকায় এসে বসবাস শুরু করেন। গত ৩০ সেপ্টেম্বর সাভারের আশুলিয়া জামগড়া এলাকায় বহুতল ভবনের ৪র্থ তলার একটি ফ্ল্যাট থেকে দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়লে ভবনের অন্য ভাড়াটিয়ারা বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে অবগত করে। পরে ফ্ল্যাট থেকে মোক্তার ও তার স্ত্রী সাহিদাসহ ১২ বছরের শিশু সন্তান মেহেদীর অর্ধগলিত গলাকাটা মরদেহ উদ্ধার করা হয়।
এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় রোববার (১ অক্টোবর) আশুলিয়া থানায় অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিদের আসামি করে একটি হত্যা মামলা করা হয়। একই পরিবারের তিনজনকে হত্যার ঘটনায় গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ায় র্যাব। গত রাতে র্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখা ও র্যাব-৪ এর একটি দল গোপন সংবাদের ভিত্তিতে গাজীপুরের শফিপুর এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে হত্যাকাণ্ডের হোতা সাগর আলী (৩১) ও তার স্ত্রী ঈশিতাকে (২৫) আটক করে। সাগর টাঙ্গাইলের মোবারক ওরফে মোগবর আলীর ছেলে। আটকের সময় তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় হত্যাকাণ্ডের সময় মোক্তারের ব্যবহৃত আংটি।
সাগর আলী ও তার স্ত্রী ঈশিতাকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের ভিত্তিতে ঘটনার বিবরণ দিয়ে কমান্ডার মঈন বলেন, গত ২৮ সেপ্টেম্বর সাগর সাভারের বারইপাড়া এলাকার একটা চায়ের দোকানে চা খাওয়ার সময় মোক্তারকে পাশের একটি কবিরাজি ও ভেষজ ওষুধের দোকানে তার শারীরিক সমস্যার বিষয়ে চিকিৎসা নিয়ে কথা বলতে দেখেন। পরে সাগর জানতে পারেন, মোক্তার ওই দোকানে ভেষজ ও কবিরাজি চিকিৎসা বাবদ ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা খরচ করেও কোনো ফলাফল পাননি। সাগর কৌশলে মোক্তারকে ডেকে নিয়ে কথোপকথনে তিনি ভেষজ ও কবিরাজি চিকিৎসায় সমাধান করে দেবেন বলে জানান। মোক্তার ও তার স্ত্রীর বেশ কিছু শারীরিক সমস্যার কথাও সাগরকে জানান মোক্তার। এরপর সাগর মোক্তারকে বলেন, তার স্ত্রী একজন ভালো কবিরাজ এবং তিনি তার সমস্যার সমাধান করে দিতে পারবেন। এমন মিথ্যা আশ্বাসের এক পর্যায়ে ৯০ হাজার টাকায় মোক্তারের সঙ্গে চুক্তি করেন। সাগর ও তার স্ত্রী পরদিন (২৯ সেপ্টেম্বর) সকালে ওষুধসহ মোক্তারের বাসায় গিয়ে চিকিৎসা করবেন বলে জানান। পাশাপাশি তাদের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য মোক্তারকে সাগর নিজের মোবাইল নম্বর না দিয়ে এক আত্মীয়ের নম্বর দেন। এ সময় সাগরের স্ত্রী ঈশিতাকে মোক্তার শারীরিক সমস্যার কথা জানান। পরে তারা মোক্তারকে পরিকল্পনা অনুযায়ী ইসবগুলের শরবতের সঙ্গে চেতনানাশক খাইয়ে তাদের অর্থসহ মূল্যবান সামগ্রী লুট করেন। এর আগে সাগর গাজীপুরের মৌচাক এলাকার একটি ফার্মেসি থেকে এক বক্স ঘুমের ওষুধ ক্রয় করেন বলেও জানান।
তিনি বলেন, এর আগে পরিকল্পনা অনুযায়ী ২৯ সেপ্টেম্বর সকালে সাগর ও তার স্ত্রী গাজীপুরের মৌচাক থেকে মোক্তারের সঙ্গে জামগড়া মোড়ে সাক্ষাৎ করতে তাদের বাসায় যান। সেখানে প্রাথমিক পরিচয়ের পর সাগরের স্ত্রী ঈশিতা তাদের সমস্যার কথা শুনেন। পরে চেতনানাশক খাইয়ে মোক্তার ও তার স্ত্রী-ছেলে ঘুমিয়ে পড়লে সাগর ও তার স্ত্রী মিলে প্রথমে মোক্তারের কক্ষে গিয়ে মোক্তার ও তার স্ত্রীর হাত ও পা বাঁধেন। পরে তারা মোক্তারের মানিব্যাগ ও বাসার অর্থ ও মূল্যবান সামগ্রী তল্লাশি করে মাত্র ৫ হাজার টাকা পান। পরে ক্ষিপ্ত হয়ে বটি দিয়ে প্রথমে মোক্তারের গলা কেটে তারা হত্যা করেন। পরে অন্য কক্ষে গিয়ে ছেলে ও স্ত্রীকে একই বটি দিয়ে পর্যায়ক্রমে কুপিয়ে হত্যা করেন। পালানোর আগে তারা মোক্তারের ব্যবহৃত আংটি খুলে নিয়ে যান।
কমান্ডার মঈন বলেন, সাগর দম্পতি ভিন্ন পথে রিকশাযোগে গাজীপুরের মৌচাকে তার শ্বশুরবাড়ি যান এবং সেখানেই অবস্থান করতে থাকেন। হত্যাকাণ্ডের ঘটনা গণমাধ্যমে প্রচারের পর তারা আত্মগোপনে চলে যান। পরে আত্মগোপনে থাকাকালেই গাজীপুরের শফিপুর এলাকা থেকে তাদের গত রাতে আটক করা হয়। এর আগে ২০২০ সালে একই কায়দায় টাঙ্গাইলে চারজনকে হত্যা করেছেন সাগর।
সিরিয়াল কিলার সাগরের বিষয়ে কমান্ডার মঈন বলেন, সাগর মাদকাসক্ত এবং বিভিন্ন পেশার আড়ালে চুরি ও ছিনতাই করতেন বলে জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন। ২০২০ সালে টাঙ্গাইলের মধুপুরে ২০০ টাকার জন্য একই পরিবারের চারজনকে চেতনানাশক খাইয়ে একই কায়দায় গলা কেটে হত্যায় অভিযুক্ত সাগর।
ওই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সাগর র্যাব-১২ কাছে আটক হয়ে সাড়ে তিন বছর কারাভোগ করে ২০২৩ সালের জুন মাসে জামিন পেয়ে গাজীপুরের মৌচাক এলাকায় তার শ্বশুরের ভাড়া বাসায় কিছুদিন অবস্থান করেন। দীর্ঘদিন জেলহাজতে থাকায় তার আর্থিক অবস্থা ভালো না থাকায় তিনি রাজমিস্ত্রি, কৃষি শ্রমিকসহ বিভিন্ন পেশার আড়ালে ঢাকা, সিলেট ও টাঙ্গাইলে অবস্থান করে সুযোগ বুঝে চুরি ও ছিনতাই করতেন।
একটি জেলায় বেশ কিছুদিন অবস্থানের পর স্থান পরিবর্তন করে অন্য জেলায় আশ্রয় নিতেন সাগর। এছাড়াও তিনি অবৈধ পথে পার্শ্ববর্তী দেশে জুলাই মাসে গমন করে ২০-২৫ দিন অবস্থান করে এবং আগস্ট মাসে দেশে ফিরে কুমিল্লায় কিছুদিন অবস্থান করেন। সাগর দম্পতির বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে বলে জানিয়েছেন র্যাব কমান্ডার মঈন।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে কমান্ডার মঈন বলেন, সাগর কিন্তু চিহ্নিত সন্ত্রাসী না বা শীর্ষ সন্ত্রাসীও না। তবে সাগর আমাদের জানিয়েছেন একটি স্বার্থান্বেষী মহল তাকে ব্যবহারের চেষ্টা করেছে। এসব তথ্য পেলেই তাদের আইনের আওতায় আনা হবে।