ধর্ম ও জীবনঃ একজন মুসলিমের কাছে জীবনের একটা লক্ষ্য আছে, উদ্দেশ্য আছে। কিন্তু কোনো প্রকার স্রষ্টায় বিশ্বাস করে না যারা, তাদের জীবনের লক্ষ্য কী? উদ্দেশ্য কী? বিভিন্ন নাস্তিক্যবাদীকে আপনি বলতে শুনবেন যেঃ “আমাদের নিজেদেরকেই নিজেদের জীবনের অর্থ তৈরি করে নিতে হবে”। কিন্তু তাদের এই মতাদর্শের মাঝে বড়সর সমস্যা আছে। যেমন ধরুন, তারা মনে করে যে এই মহাবিশ্ব আসলে “প্রকৃতির খেয়ালে” হয়েছে। এই মহাবিশ্ব, গ্যালাক্সিসমূহ, সৌরজগত, পৃথিবী, এর প্রাণের বিকাশ এই সব কিছু কোনো বুদ্ধিমান সত্ত্বার আদেশ ব্যতিত এমনিতেই বহুকাল ধরে ধাপে ধাপে হয়েছে।
এর পেছনে কোনো ‘উদ্দেশ্য’ নেই। তাদের মতাদর্শ অনুযায়ী পৃথিবী ও এর মাঝের সবকিছুই “নাক্ষত্রিক ধূলিকণা” এবং এরপর “ক্রমাগত রাসায়নিক বিক্রিয়ার ফলাফল” ছাড়া কিছুই না। আর এক সময় এর সবকিছুই ধ্বংস হয়ে যাবে, একবার ধ্বংস হবার পরে আর কোনো জীবন নেই। তাই যদি হয়ে থাকে, তাহলে কে কী বিশ্বাস করলো বা কে কী করলো এতে তো কিছুই আসে যায় না।
কেউ নাৎসিবাদে বিশ্বাস করুক, কেউ লিবারেলিজমে বিশ্বাস করুক, কেউ কমিউনিজমে বিশ্বাসী হোক বা ইসলামে বিশ্বাসী হোক – এরা সবাই আসলে “প্রকৃতির খেয়ালে” দুনিয়ায় এসেছে, আর সবাই একই পরিণতির শিকার হবে। আর তা হলোঃ চির ধ্বংস। তাহলে কে কী জিনিসে বিশ্বাস করলো আর কেমন কর্ম করলো এতে কি কিছু আসে যায়? সবাই তো “নাক্ষত্রিক ধূলিকণা” থেকে ‘দুর্ঘটনাক্রমে” জীবন লাভ করেছে। এরপর এক সময় তো ধ্বংসই হয়ে যাবে।
নিরিশ্বরবাদী বিবর্তনবাদীরা মনে করে, আমাদেরকে কেউ কোনো বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে তৈরি করেনি। অর্থাৎ আমাদের এই জীবনের কোনো ‘উদ্দেশ্য’ নেই। এই বিষয়গুলো নিয়ে হতাশার জন্যই কি নাস্তিকরা অনবরত ইসলাম ও বিভিন্ন ধর্মকে আক্রমণ করতে থাকে? নাস্তিকদের বিভিন্ন ব্লগে ও লাইভে দেখবেন তারা বিভিন্ন ধর্মকে (বিশেষত ইসলামকে) অনবরত আক্রমণ করে অসার প্রমাণের চেষ্টা করে। তারা ইসলামের বিভিন্ন দিককে উল্লেখ করে এগুলোকে ‘মধ্যযুগীয়’, ‘বর্বর’ বলে দাবি করে। আমাদের প্রশ্ন হচ্ছে, এগুলো যে খারাপ বা বর্বর – এর প্রমাণ কী? কিসের ভিত্তিতে ইসলামের এই দিকগুলো খারাপ বা বর্বর? কোনো মানদণ্ডের ভিত্তিতে? একজন মুসলিমের কাছে মানদণ্ড হচ্ছে কুরআন ও সুন্নাহ।
কুরআন ও সুন্নাহ অনুযায়ী যা ভালো, মুসলিমদের কাছেও তা ভালো। কুরআন-সুন্নাহ অনুযায়ী যা খারাপ, একজন মুসলিমের কাছেও তা খারাপ। সব সময়ে এই একই মানদণ্ড। কিন্তু নিরিশ্বরবাদীদের কোনো নির্দিষ্ট মানদণ্ড নেই। সময়ে সময়ে তাদের মানদণ্ড বদলে যায়। সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতকে ইউরোপে কিছু লিবারেল দার্শনিক যেসব মতবাদ দিয়েছেন [যেমনঃ জীবনে সর্বোচ্চ সুখী হওয়া, কারো ক্ষতি না করা, সমতা] এগুলোর আলোকেই এখনকার সেকুলার-লিবারেল নাস্তিকরা কারো “সভ্য” হওয়া নির্ধারণ করে। কমিউনিস্ট নাস্তিকরা আবার মার্ক্সবাদ ও কমিউনিস্ট আদর্শের আলোকে তাদের এক্সটিভিজম চালায়। কিন্তু এইসব নীতিমালা অন্যরা কেন মেনে নেবে? এগুলো যে ‘সত্য’, এর প্রমাণ কী? লিবারেল বা অন্য কোনো আদর্শের দার্শনিকদের ধারণা অনুসরণ করে একজন মুসলিমকে কেন ‘সভ্য’ হতে হবে?
নাস্তিক্যবাদীরা এর জবাবে বলার চেষ্টা করেনঃ প্রাচীনকাল থেকে বিবর্তনের মাধ্যমে আমরা এইসব নৈতিকতা, সভ্যতা ইত্যাদির বোধ অর্জন করেছি। আমরা জানি অন্যের উপকার করা ‘ভালো’, ক্ষুধার্থকে খাবার দেয়া ভালো কাজ, রক্ত দান করা ভালো কাজ। কিন্তু এই কথাগুলোর মধ্যে শুভঙ্করের ফাঁকি আছে।
প্রথমত,
তাদের নিজেদের কথা অনুযায়ী এগুলো বিবর্তনের ফল। বিবর্তন কি ‘নৈতিকতা’ শেখায় নাকি এতে শুধু যোগ্যতররা টিকে থাকে? ধরুন, একটা শক্তিশালী গোত্র আরেকটা দুর্বল গোত্রকে মেরে ফেলে তাদের সর্বস্ব লুটে নিলো। বিবর্তনের আলোকে এটা কি “ভুল”? বিবর্তনের আলোকে আপনি ‘সঠিক’ বা ‘ভুল’ এর ধারণা কিভাবে পাবেন? ন্যায় বা অন্যায়ের ধারণা কিভাবে পাবেন?
দ্বিতীয়ত,
একেকজনের নিকট নৈতিকতার ধারণা একেক রকম হতে পারে। এই বিভিন্ন ব্যক্তিও [নিরিশ্বরবাদী বিবর্তনবাদীদের মতে] বিবর্তনেরই ফসল। রবিন হুডের কাছে মনে হতে পারেঃ ধনীদের লুট করে দরিদ্রদের মাঝে বিলিয়ে দেয়া “ভালো কাজ”। প্রিন্স জনের কাছে এই একই কাজ ‘সন্ত্রাসবাদ’ গণ্য হতে পারে। এখানে কে ‘ঠিক’ আর কে ‘ভুল’?
হিটলারের কাছে ইহুদিদের গণহত্যা করা আর “আর্য জাতি” জার্মানদের আধিপত্য বিস্তার করা ‘সঠিক কাজ’। আবার মিত্রবাহিনীর কাছে এই একই কাজ ছিল ‘বর্বরতা’। যারা হিটলারের কাজকে ‘বর্বরতা’ বলে, তারাই আবার পৃথিবীতে মানবজাতির আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছে, মানবজাতির কল্যাণের জন্য অনেক প্রাণীকে গিনিপিগ বানিয়ে কেটে ছিড়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছে। মানুষের ভক্ষণের জন্য প্রাণী ও উদ্ভিদ ‘হত্যা’কে তারা ‘বর্বরতা’ মনে করে না।
শুধু জার্মানদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা যদি ‘বর্ণবাদ’ হয় বা ‘বর্বরতা’ হয়, তাহলে সম্পূর্ণ ‘মানবজাতির’ আধিপত্য প্রতিষ্ঠা কেন ‘বর্বরতা’ হবে না? কেউ যদি একে ‘সাম্প্রদায়িকতা’ বা ‘বর্বরতা’ দাবি করে আর যদি বলেঃ এই পৃথিবীতে একটা খরগোশের কিংবা একটা আমগাছেরও ‘সমান’ অধিকার আছে (বা বেশি অধিকার আছে), একটা খরগোশ বা একটা আমগাছকে বাঁচানোর জন্য একজন মানুষের জীবন নিয়ে নেয়া যেতে পারে – তাহলে তার এই মতবাদ কি ‘সঠিক’? নাকি ‘ভুল’? একজন স্রষ্টা না থাকলে কিভাবে এটা নির্ধারিত হবে? সবাই তা মানতে বাধ্যও বা হবে কেন? আর কেউ সেটা না মানলে তাকে ‘বর্বর’ তকমা লাগানো যাবে কি না?
তৃতীয়ত,
আর স্রষ্টা যদি থেকে না থাকে, তাহলে কেউ যদি ‘ভুল’ বা ‘বর্বর’ মতাদর্শও বেছে নেয়, এতে কি কিছু আসে যায়? দিনশেষে একজন ‘সভ্য’ মানুষ আর একজন ‘অসভ্য’ মানুষ সবাই তো বিবর্তনেরই ফল! আর একসময় এই সব মানুষ + সমগ্র মহাবিশ্বই ধ্বংস হয়ে যাবে। সবকিছুর ফলাফলই শুন্য। লিবারেল, কমিউনিস্ট, পুঁজিবাদী, সমাজবাদী, নারীবাদী, নাৎসিবাদী, গান্ধীবাদী, হিন্দুত্ববাদী – সবার শেষ পরিনতিই এক।
শুন্য। বিশাল এক শুন্য।
কেন একজন মানুষ ‘ভালো’ হয়ে চলবে? সবাই তাহলে ‘নৈতিক’ জীবন বেছে নেবে কেন? এসবের অর্থ কী?
মানুষ নিজেই নিজের জীবনের অর্থ তৈরি করে নেবে? কিসের ভিত্তিতে করবে? কেন করবে? কিভাবে করবে?
সুখীভাবে বেঁচে থাকার চেষ্টা করবে? মুসলিমরা পূর্ণ ইসলামী জীবনব্যাবস্থার অধীনে যদি ‘সুখী’ হয়ে বাস করে, তাহলে তারা কিসের ভিত্তিতে ইসলামকে ‘অনৈতিক’ বা ‘বর্বর’ প্রমাণ করবে? একজন মুসলিমের জীবনের একটা অর্থ আছে উদ্দেশ্য আছে। নাস্তিক্যবাদীদের নিজেদের ব্যাপারে এমনটি দাবি করার মতো নৈতিক ভিত্তি নেই। তাদের নিজেদের মতাদর্শের ভিত্তিতেই তাদের এটা নেই। কোনো নাস্তিক্যবাদী এমন দাবি করে যেঃ আমরা একটা ক্ষুধার্থ প্রাণীকে খাদ্য দিয়ে বা অসহায় মানুষের সেবা করে জীবনকে ‘অর্থপূর্ণ’ করে তুলতে পারি।
কিন্তু এটাও তো তাদের নিজদের বানানো অর্থ। এই অর্থের সাথে কেউ একমত না হলে কিভাবে তা ভুল প্রমাণিত হবে? কেউ যদি সিরিয়াল কিলিং করা কিংবা ধর্ষণ করাকে জীবনকে ‘অর্থপূর্ণ’ করার মাধ্যম হিসেবে নেয় তাহলে এই অর্থকে ভুল প্রমাণ করার উপায় কী যদি কোনো স্রষ্টা না থাকে, স্রষ্টার বিধান না থাকে আর পরকালের বিচার না থাকে? আর তাদের মতাদর্শ অনুসারে এই অর্থের এই অনুভূতিগুলোও তো মানবদেহের বিভিন্ন চিন্তাধারা তথা বিভিন্ন রাসায়নিক প্রক্রিয়ারই ফলাফল।
আমরা দাবি করি না যে নাস্তিক হলেই কেউ খুনী, মাদকাসক্ত হয় বা চরিত্রহীন হয়। কোনো কোনো নাস্তিকও দানশীল হতে পারে, পরোপকারী হতে পারে। কিন্তু কোনো স্রষ্টা না থাকলে কেউ মাদকাসক্ত হলেও কিছু আসে যায় না, দানশীল হলেও আসে যায় না, খুনী হলেও কিছু আসে যায় না। দিনশেষে সব কিছুই ধ্বংসশীল, সবকিছুই শুন্যে বিলীন হবে। আর ফিরে আসবে না, কোনো বিচার হবে না।
স্রষ্টাবিহীন নাস্তিকদের মতাদর্শের আসলে কোনো অর্থ নেই। তারা সব সময় দাবি করে ‘প্রমাণ’ ছাড়া কিছু বিশ্বাস করে না। অথচ সেই তারাই প্রমাণবিহীন কিছু নৈতিকতার ধারণা দিয়ে ইসলামের বিরুদ্ধে দিন-রাত ক্যাম্পেইন চালায়। তাদের এই সকল কর্মপ্রয়াস আসলে অর্থহীন, সময়ের অপব্যয়।
আমরা আল্লাহর নিকট সকলের হেদায়াতের জন্য দোয়া করি। আমরা সকলকে ইসলামের দিকে আহ্বান করি। অর্থহীন জীবন ও বানোয়াট মতাদর্শ ছেড়ে সারা জাহানের সৃষ্টিকর্তার আনুগত্যের দিকে ফিরে আসার আহ্বান করি, অর্থপূর্ণ জীবনের দিকে আহ্বান করি।
“আর আমি আসমানসমূহ, যমীন এবং এতদোভয়ের মধ্যে যা কিছু আছে তা খেলাচ্ছলে সৃষ্টি করিনি।”[আল কুরআন, দুখান ৪৪ : ৩৮]
“আর জিন ও মানুষকে কেবল এজন্যই সৃষ্টি করেছি যে তারা আমার ইবাদাত করবে।”[আল কুরআন, যারিয়াত ৫১ : ৫৬]
“আর যদি সত্য তাদের কামনা-বাসনার অনুগামী হত, তবে আসমানসমূহ, যমীন ও এতদোভয়ের মধ্যস্থিত সব কিছু বিপর্যস্ত হয়ে যেত; বরং আমি তাদেরকে দিয়েছি তাদের উপদেশবাণী (কুরআন)। অথচ তারা তাদের উপদেশ হতে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে।”[আল কুরআন, মু’মিনুন ২৩ : ৭১]
“নিশ্চয় যারা ঈমান এনেছে এবং সৎকাজ করেছে তাদের জন্য রয়েছে জান্নাত, যার পাদদেশে নদী প্রবাহিত; এটাই মহাসাফল্য।”[আল কুরআন, বুরুজ ৮৫ : ১১]